রাজনীতি করার সময় অনেক পাওয়া যাবে। মানবিক বিপর্যয় নিয়ে রাজনীতি চলে না। বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে ভারতকে অভিযুক্ত না করে এই মুহূর্তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো সকল সংকীর্ণতার উর্ধ্বে উঠে দল ও মতের ভেদাভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সর্বশক্তি দিয়ে মানুষ ও গবাদিপশু রক্ষায় এগিয়ে আসা। দল ও মতের পার্থক্য ভুলে জাতীয় ঐক্য এই মুহূর্তে সময়ের সবচেয়ে বড় দাবী।
পরিস্থিতির জন্য ভারতকে দায়ী করাটা রাজনৈতিক কৌশল হতে পারে, তবে এই কৌশলে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের প্রতি জনমনে বিদ্বেষ ছড়ানো ছাড়া বিশেষ কিছু অর্জিত হবে বলে মনে হয় না। কারণ ভারতের নিজের ভূখণ্ডেই বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ। বিবিসি বাংলা সূত্রে জানা যায় ত্রিপুরার গোমতী জেলায় আগস্ট মাসে যেখানে স্বাভাবিক বৃষ্টি হওয়ার কথা ১৯৬.৫ মিলিমিটার, সেখানে বৃষ্টি হয়েছে ৬৫৬.৬ মিলিমিটার, যা স্বাভাবিকের চেয়ে ২৩৪% বেশি। অপরদিকে ত্রিপুরার রাজ্য সরকার বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছে গত তিন দশকেরও বেশি সময়ের মধ্যে রাজ্যটিতে ভয়াবহ বন্যা হচ্ছে এবছর। ফেসবুকে অনেকে বলছেন ভারত অন্যায়ভাবে গোমতী বাঁধে গেট খুলে দেওয়ার কারণে বাংলাদেশে বন্যা পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়েছে। জনগণের এ দাবী কতটা যৌক্তিক বা তথ্যভিত্তিক তা বলতে পারবেন আমাদের নদী বিশেষজ্ঞগণ এবং যৌথ নদী কমিশনের কর্তাবৃন্দ। এটি একটি কারিগরি বিষয়। সাধারণ মানুষের পক্ষে কারিগরি বিষয়ে সঠিক তথ্য জানা সম্ভব নয়। যে কারণে একজনের দেখাদেখি অন্যজন ভারতবিদ্বেষী পোস্ট শেয়ার করছেন এবং জনমনে বিভ্রান্তি ও বিদ্বেষ ছড়াচ্ছেন। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে ভারতের সঙ্গে আমাদের ৫৪টি আন্তসীমান্ত নদী রয়েছে। সুতরাং তাদের প্রতি বিদ্বেষ ছড়িয়ে নয় বরং বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের মাধ্যমে পারস্পরিক সম্প্রীতির ভিত্তিতে আমাদেরকে আন্তসীমান্ত নদী ও অন্যান্য সমস্যার সমাধান করতে হবে।
প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে বৈরীতায় জড়িয়ে সমস্যার সমাধানতো হবেই না বরং আমরা ভূরাজনৈতিকভাবে আরও বেশি ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যাবো। এই যে আমরা গোমতী বাঁধে গেট খুলে দেওয়ার অভিযোগ করছি ভারতের বিরুদ্ধে, দেখা যাক সে দাবী কতটা যৌক্তিক। বিবিসি বাংলা এ বিষয়টি নজরে এনেছে ত্রিপুরা রাজ্য সরকারের। রাজ্যটির বিদ্যুতমন্ত্রী বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, " গোমতী জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের কোনও গেট খুলে দেওয়া হয়নি। এই জলাধারটির সর্বোচ্চ ধারণ ক্ষমতা ৯৪ মিটার। জলস্তর এর বেশি উঠলেই নিজের থেকে গেট দিয়ে জল বেরিয়ে যাবে। জলস্তর আবার নিচে নেমে গেলে নিজের থেকেই গেট বন্ধ হয়ে যাবে। জলস্তর সর্বোচ্চ ধারণ ক্ষমতার বেশি হয়ে যেতেই জলাধারের দুটি গেট দিয়ে জল বেরোচ্ছে। এর মধ্যে একটি গেট দিয়ে ৫০% হারে জল বেরোচ্ছে।" এখন প্রশ্ন হলো ত্রিপুরার বিদ্যুৎমন্ত্রী গোমতী বাঁধ নিয়ে বিবিসি বাংলাকে যে তথ্য দিলেন সেটি কতটা সঠিক? অতিরিক্ত পানির চাপে নিজে থেকে গেট খুলে যাওয়া এবং পানির স্তর নিচে নেমে গেলে বন্ধ হয়ে যাওয়ার বিষয়টি পরিষ্কার করে বলতে পারবেন বাঁধ বা নদী বিশেষজ্ঞগণ। যৌথ নদী কমিশনের সাথে সম্পৃক্ত আমাদের কর্মকর্তারাও জানবেন ত্রিপুরা রাজ্যের মন্ত্রীর এই ব্যাখ্যা কতটা গ্রহনযোগ্য।নদী বিশেষজ্ঞ বা যৌথ নদী কমিশনের কারও কাছ থেকে এ বিষয়ে এখনও কোনও বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য ছাড়া শুধুমাত্র আবেগের বশবর্তী হয়ে কিংবা ভারতবেদ্বেষী মনোভাব থেকে বন্যা পরিস্থিতির জন্য ভারতকে দোষারোপ করা কখনোই সমীচীন হতে পারে না। এতে আমাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের অবনতি বৈ উন্নতি হবে বলে মনে করি না। তাই আসুন, জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে বিদ্বেষ না ছড়িয়ে আমরা বন্যাদুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়াই। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে নিশ্চয় বাংলাদেশ সরকার তদন্ত করে দেখবেন গেট খুলে দেওয়া নিয়ে প্রকৃত ঘটনা কী ঘটেছে এবং এ নিয়ে ভারতের বক্তব্য কতটা গ্রহনযোগ্য ছিল। ভারত যদি অন্যায়ভাবে গেট খুলে দিয়ে আমাদের দেশে মানবিক বিপর্যয় ঘটিয়ে থাকে তাহলে তার দায়দায়িত্ব অবশ্যই ভারতকে নিতে হবে। বোধকরি এটি হবে তখন আন্তসীমান্ত নদী নিয়ে আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন। ভারত সে ঝুঁকি নেবে বলে মনে হয় না।
নেটিজেনদের অনেকে বলছেন শেখ হাসিনাকে দেশছাড়া করার কারণে পানি ছেড়ে দিয়ে ভারত বাংলাদেশের ওপর কঠিন প্রতিশোধ নিচ্ছে। বিষয়টি স্রেফ ভারত বিদ্বেষ ছাড়া আর কিছুই নয়। কারণ বাংলাদেশ বন্যায় আক্রান্ত হয়ে বিপর্যয়ের শিকার হলে শেখ হাসিনার জন্য পুনরায় ক্ষমতায় আসার পথ সুগম হওয়ার কোনও সম্ভাবনা-ই নেই। বরং যা হবে তা হলো বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আরও ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যাবে। আঠারো কোটি মানুষ তখন ভারত বর্জন কর্মসূচীতে অংশ নেবেন। ফলে ভারত তাদের ১২ বিলিয়ন ডলারের বাজার হারাবে। একইসঙ্গে তাদের চারহাজার কিলোমিটার সীমান্ত অস্থিতিশীল হয়ে যাবে। শেখ হাসিনা ভারতের যতই বন্ধু হোন না কেন আঠারো কোটি মানুষে বিরুদ্ধে গিয়ে প্রতিবেশী দেশের একজন রাজনীতিবিদের জন্য এরকম আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নেওয়ার মত ভুল ভারত করবে বলে মনে হয় না।