বাংলাদেশ ২৬ আগস্ট ২০২৪

জনতার ডিম নিক্ষেপ এবং সুশীলের উৎকণ্ঠা নিয়ে দুটি কথা :

post

  জঙ্গলের ভেতরে তিনটে কলাপাতা বিছিয়ে পাশ ফিরে শুয়ে আছেন এক অশীতিপর (?) বৃদ্ধ। পা দুটো তার ভাঁজ করা। সারামুখে সীমাহীন ক্লান্তির ছাপ। দেখে মনে হয়ে কতোদিন পেট ভরে খায়নি, ভাল করে ঘুমোয়নি। ভয়, উৎকণ্ঠা আর ক্লান্তিতে মুখটা শুকিয়ে আছে। আ - হা। দেখলেই কেমন মায়া লাগে। দেখতে যেমনই হোন, একসময় দোর্দণ্ড প্রতাপশালী বিচারক ছিলেন তিনি। এমনকি তার নামটা ঠিক মতো উচ্চারন করতে না পারা কিম্বা রাস্তায় দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশ বেখেয়ালে তাঁকে স্যালুট দিতে ভুলে যাওয়া ছিল মস্তবড় শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তার এক কলমের খোচায় কত কত দাগী আসামি ফাসিতে ঝুলেছে।

এমন সর্বজনশ্রদ্ধেয় মানুষটাকে ডিম ছুড়ে মারছে, জুতো ছুড়ে মারছে, চড় থাপ্পড় মারছে! কী ভীষণ বর্বরতা! এরা কি মানুষ! একজন অভিজাত চেহারার ভদ্রমহিলা। সারাজীবন নিজেকে শিক্ষানুরাগী হিসেবে পরিচয় দিয়ে এসেছেন। জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়নে ছিল তার মস্তোবড় ভূমিকা। বড় বড় সেমিনারে স্বনামধন্য বুদ্ধিজীবীরা অত্যন্ত মনোযোগী শ্রোতারা মতো উনার বক্তৃতা শুনেছেন, প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছেন। তাঁকে হেলমেট পড়িয়ে আদালতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আশেপাশের মানুষ তার দিকে পচা ডিম, থুতু আর স্যান্ডেল ছুড়ে মারছে। কী সব বর্বরতা! এরা কি মানুষ! দেবতুল্য মুখাবয়বের একজন দরবেশ আর ছাত্রদের ‘পিতৃতুল্য’ একজন আইনজ্ঞকেও কিনা হেলমেট পড়িয়ে আদালতে নেয়া হচ্ছে! তাদের দিকে ছুড়ে মারা হচ্ছে পচা ডিম, স্যান্ডেল আর থুতু! কী অসভ্যতা! এরা কি মানুষ! না, এরা মানুষ না। এরা অতিমানব। এরা গর্বিত বাংলাদেশী। 

আমার ভাই। কী অবাক হলেন তো! ভাবছেন, ছি, ছি! একজন শিক্ষিত সচেতন ব্যক্তি হয়েও আপনি এদের পক্ষে সাফাই গাচ্ছেন! ঠিক তাই, ইতিহাস, নৃবিজ্ঞান আর মনঃস্তত্ব নিয়ে কিঞ্চিত লেখাপড়া করেছি বলেই বলছি, এরা মানুষ নয়, অতিমানব। চলুন একটু ইতিহাসের অলি গলিতে ঘুরে আসা যাক।

 উজবেকিস্তানের মানুষগুলো ভীষণরকম ভদ্র, নিরীহ এবং অতিথিবৎসল। একেবারেই নিরেট ভালোমানুষ। ওদের প্রতিটি রাস্তার মোড়ে, প্রতিটি স্থাপনার সামনে একটি ব্যক্তির স্ট্যাচু দেখতে পাবেন। স্ট্যাচুর ব্যক্তিটি হলেন তৈমুর লং। উজবেকরা এই ভদ্রলোককে দেবতার মতো সম্মান করে। এই তৈমুর লং যখন অটোমান সাম্রাজ্যের পতন ঘটান, তখন তিনি কি করেছিলেন জানেন? শেষ অটোমান সুলতান বায়েজীদকে অর্ধ উলঙ্গ অবস্থায় একটা চিড়িয়াখানার পশুর খাঁচায় ঢুকিয়ে সেই খাচা একটি ঘোড়ার গাড়ীতে করে পুরো শহর ঘুরিয়েছেন। যাতে প্রতিটি অটোমান নাগরিকের ছিটেফোঁটা আত্মসম্মানবোধটুকুকেও ধুলিস্যাত করে দেয়া যায়। তৈমুর লং কে যদি আপনি মানুষ ভাবেন, তবে শুধু ডিম ছুড়ে যারা ক্ষোভ প্রকাশ করে তারা অতিমানব নয়তো কি?

পলাতক সাদ্দাম হোসেনকে যখন বিদ্রোহী সৈন্যরা খুঁজে পেল, তখন এই বয়স্ক মানুষটাকে ওরা পায়ুপথে ধর্ষণ করেছিল। সেটা কি জানা আছে আপনার? একসময় পৃথিবীর সভ্যতার কেন্দ্রে থাকা বাগদাদের মানুষগুলো যদি এই কাজ করে, তবে শুধু খানকয়েক ডিম ছুড়ে ক্ষেদ প্রকাশ করা লোকগুলোকে অতিমানব বলতেই হয়। এরকম আরও ভুরি ভুরি উদাহরণ দেয়া যাবে। লেখা বড় হয়ে যাচ্ছে বলে ক্ষান্ত দিচ্ছি। নৃবিজ্ঞানে Anthropology of Violence বা সহিংসতার নৃতত্ত্ব শিরোনামে একটি সাবজেক্ট পড়ানো হয়। এই পুরো বিষয়টির একটি মৌলিক প্রস্তাবনা হচ্ছে, সহিংসতা প্রতিটি মানুষের একটি সহজাত প্রবণতা যা তার গভীর অবচেতন মনে ঘাপটি মেরে থাকে এবং সুযোগ পেলেই বেড়িয়ে আসার চেষ্টা করে। এই অবচেতন মনে ঘাপটি মেরে থাকা Violent Instinct বা সহিংস প্রবণতাকে মাঝে মাঝে অবমুক্ত করে দিতে হয়। অন্যথায় মানুষ দানবে পরিণত হয়।

খেলাধুলো এই হিংস্রতাকে অবমুক্ত করার একটি সহজ মাধ্যম। যে কোন দলগত খেলায় একটি প্রতিপক্ষ দল থাকে। প্রতিপক্ষ দলকে খেলায় পরাজিত করার সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে এই হিংস্র প্রবৃত্তি ধীরে ধীরে অবমুক্ত হতে থাকে। ক্রিকেটে উইকেট ফেলে দেবার পর বোলারের মুখভঙ্গি কেমন হয় লক্ষ্য করেছেন? কিম্বা ফুটবলে গোল করার পর যে গোল করে তার প্রতিক্রিয়া ভালভাবে লক্ষ্য করেছেন? একটু লক্ষ্য করবেন, বুঝতে পারবেন। যাই হোক, যেই মানুষগুলো ডিম ছুড়ে মেরেছে তাদের দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ, ভেতরের সহিংস প্রবণতাকে অবমুক্ত করার কোন সুযোগই ছিলোনা। তারা দিনের পর দিন, বছরের পর বছর নির্যাতিত হয়েছে। কিন্তু ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটানোর বিন্দুমাত্র সুযোগ পায়নি। তারপরও তো ওরা দানবের মতো আচরণ করেনি। শুধু পচা ডিম, থুতু আর স্যান্ডেল ছুড়ে মেরেছে। ওরা তো মহামানব! এতো সহ্যক্ষমতা এদের আসে কোত্থেকে! আমি সত্যিই অবাক, এরা তো অসাধারণ ভালো মানুষ! আর আপনারা কিনা এদের ধিক্কার দিচ্ছেন! আবু সাইদ, ইয়ামীন কিম্বা মুগ্ধদের মতো অসংখ্য শহীদ, ছাদের কার্নিশে ঝুলে থাকা যে ছেলেটিকে ওরা এইম করে খুব কাছ থেকে চার চারটি গুলি ছুড়েছে সে, মিথ্যা মামলায় ফাসিপ্রাপ্ত কেউ অথবা ফাসির দন্ডপ্রাপ্ত যে মানুষটার বুকের ওপোর পা তুলে দিয়ে হাসিনা পশুর মতো জবাই করছে এদের একজনও যদি আপনার ভাই বা সন্তান হোত, আপনি কি এভাবেই পরিশীলিত ভাষায় সুশীলের মতো কথা বলতে পারতেন? প্লীজ হিপোক্রেসী করবেন না।

 সবশেষে Mediation নিয়ে কিছু কথা। আন্তর্জাতিকভাবে Certified Mediator বা সনদপ্রাপ্ত সমঝোতাকারীরা বলেন, যখন নিপীড়ক এবং নিপীড়িতের মাঝে মেডিয়েশন করা হয়, তখন প্রথমেই নিপীড়িতকে তার সব ক্ষোভ উজাড় করে দিয়ে ইচ্ছেমত গালাগালি, কান্নাকাটি এবং উষ্মাপ্রকাশ করতে দিতে হবে। এই পুরো সেশনে অভিযুক্ত একটি কথাও বলতে পারবে না। ধরে নেয়া হয়, এভাবে প্রাণ খুলে উষ্মা প্রকাশ করতে পারলে নিপীড়িতের মনটা অনেক হালকা হয়ে যায়। ফলে নিপীড়ককে পরবর্তীতে খুব ভয়াবহ কোন পরিণতির মুখোমুখি হতে হয় না। আজ যদি এদেশের লক্ষ কোটি মানুষের অবরুদ্ধ ক্ষোভ অবমুক্ত করার সামান্য কিছু প্রয়াসকে আপনাদের কাছে বর্বরতা, অসভ্যতা কিম্বা অশালীন মনে হয়, আপনারা ভীষণ রকম অজ্ঞ, মূর্খ। নৃতত্ত্ব, মানুষের মনঃস্তত্ব কিম্বা ইতিহাসের ছিটেফোঁটা জ্ঞানও নেই আপনাদের। সুশীল সেজে বসে আছেন। সোজাসাপ্টা মানুষগুলোকে বোকা বানাচ্ছেন। একটু লেখাপড়া করুন, তারপর কথা বলবেন। নিজেদের অজ্ঞতা আর জাহির করবেন না। -ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. আবদুল্লাহ আল ইউসুফ

আরো পড়ুন!

Sidebar Banner
Sidebar Banner