এক অবিশ্বাস্য গণআন্দোলন তৈরি হয়েছে এই সরকারের বিরুদ্ধে। মিছিলে মিছিলে উত্তাল বাংলাদেশ। দাবানলের মতো জেলায় জেলায় ছড়িয়ে পড়ছে সুতীব্র গণআন্দোলন। প্রবল বর্ষণকে উপেক্ষা করে বৃষ্টিতে ভিজে মিছিলে সামিল হচ্ছেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার লক্ষ-কোটি জনতা।
পুলিশের তাজা গুলি, টিয়ার গ্যাস ও রাবার বুলেটকে উপেক্ষা ছাত্রদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে রাজপথে নেমে এসেছেন মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষক, অভিভাবক, শিল্পী-সাহিত্যিক, সংস্কৃতিকর্মী তথা সর্বস্তরের মানুষ।
চারদিকে আজ লক্ষ-কোটি মুষ্টিবদ্ধ হাত। মিছিল থেকে উর্ধ্ব পানে মুষ্টিবদ্ধ হাত উঠছে আর হাত নামছে। সেই সঙ্গে তীব্র নিনাদের স্লোগানে প্রকম্পিত হচ্ছে বাংলার আকাশ-বাতাস, রাজপথ। গগন বিদারী কণ্ঠে একটি স্লোগানই আজ সবচেয়ে বেশী উচ্চারিত হচ্ছে, "স্টেপ ডাউন হাসিনা", "স্টেপ ডাউন হাসিনা"। এরকম বারুদঠাসা, অগ্নিপুঞ্জ গণবিস্ফোরণ সুদীর্ঘকাল দেখেনি এ বাংলার মানুষ।
এ যেন আরেক একাত্তর! স্বাধীনতার অর্ধ-শতাব্দী পর আরেক স্বাধীনতার আকাঙ্খায় জেগে উঠেছে এ জনপদের নিপীড়িত, নিষ্পেষিত মানুষ।মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় মুক্তির নব আন্দোলনে সমগ্র বাংলাদেশ আজ একাট্টা, সারা জাতি আজ একাত্ম। সকলেই যেন "যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা" করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়তে প্রস্তুত।
বিন্দুমাত্র জীবনের পরোয়া করছে না ছাত্র-জনতা।পুলিশের চলন্ত ভ্যানের সামনে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে নির্ভিক স্কুল ছাত্রী। শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে রুখে দিচ্ছে ভ্যানের গতিপথ। পুলিশের তাজা গুলির মুখে বুক চেতিয়ে দিচ্ছে আবু সাঈদের মত শত শত অকুতোভয় শিক্ষার্থী। সৈনিকের চোখে চোখ রেখে স্পর্ধিত চেতনায় উচ্চারণ করছে, "বুকের ভেতর ভীষণ ঝড়, বুক পেতেছি গুলি কর"।
ইউটিউব ও ফেসবুক ভেসে যাচ্ছে গণআন্দোলনের সংবাদে। স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে তীব্র রোষে ফেটে পড়ছেন ছাত্র, শিক্ষক ও অভিভাবক। লক্ষ-কোটি ফেসবুক ব্যবহারকারী সংহতি প্রকাশ করছেন ছাত্র-জনতার আন্দোলনে। অবিলম্বে সরকারের পদত্যাগ দাবী করছেন। জাতিসংঘের অধীনে এই সরকারের বিরুদ্ধে গণহত্যার তদন্ত দাবী করছেন। তীব্র ক্ষোভে নতুন প্রজন্মের কেউ কেউ বলছেন, "একাত্তর দেখিনি আমি দু'হাজার চব্বিশ দেখছি। রক্তে আগুন বইছে। ইচ্ছে করছে দেশে গিয়ে অস্ত্র হাতে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ি"।
ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম, সিলেট থেকে খুলনা, রংপুর থেকে নোয়াখালীতে— সমুদ্রের উর্মিমালার মতো আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ছে। শহরে শহরে বিক্ষুব্ধ জনতার ঢল। জেলা শহরগুলোতে জাতীয় পতাকা নিয়ে মিছিলে সামিল হচ্ছেন সর্বস্তরের মুক্তিকামী জনতা। শহরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে শুধু মিছিল আর মিছিল। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের গান গেয়ে নিজেদেরকে উদ্দীপ্ত করছেন বিপ্লবী ছাত্র-জনতা।
শুধু কী তাই! দেশের সীমানা ছাড়িয়ে এই গণআন্দোলন আজ ছড়িয়ে পড়েছে প্রবাসে। লণ্ডন থেকে নিউ ইয়র্ক, বার্লিন থেকে প্যারিস, টোকিও থেকে সিডনি, দুবাই থেকে ডাবলিন—সর্বত্র আজ তীব্র রোষে ফেটে পড়ছেন প্রবাসী বাংলাদেশী কমিউনিটি। লণ্ডনের আলতাব আলি পার্কে বাংলাদেশের এ যাবতকালের সর্ববৃহৎ জাতীয় পতাকা নিয়ে প্রতিবাদ সমাবেশ করেছেন ব্রিটিশ বাংলাদেশী কমিউনিটি। অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতো তেজস্বী বক্তৃতা দিয়ে নিউ ইয়র্কের টাইমস স্কয়ার কাঁপিয়ে দিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের চেনায় উদ্দীপ্ত হাজারো প্রবাসী বাংলাদেশী। নিউ ইয়র্ক টাইমসের মতো শীর্ষস্থানীয় খবরের কাগজ প্রথম পাতায় শীর্ষ সংবাদ হিসেবে ছেপেছে বাংলাদেশের গণআন্দোলনের খবর। পুলিশী নির্যাতনের শিকার ছাত্র-জনতার ছবি দিয়ে বড় বড় প্রতিবেদন করে চলেছে ব্রিটেনের ইণ্ডিপেনডেণ্ট, গার্ডিয়ান, ও বিবিসি থেকে শুরু ফ্রান্সের লো মঁদ এর মতো বিশ্বের বড় বড় সংবাদমাধ্যমগুলো।
ভিসুভিয়াসের মতো আজকের যেই অগ্নিগর্ভ বাংলাদেশ, নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের পর গত চৌত্রিশ বছরে এরকম অগ্নিগর্ভ বাংলাদেশ দেখেনি এ জাতি আর। টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া আজ একটাই দাবী, ''লাশের ভেতর জীবন দে নইলে গদি ছেড়ে দে"। লণ্ডন থেকে নিউ ইয়র্ক আজ একটাই দাবী, "আমার ভাই মরল কেন, খুনী হাসিনা জবাব দে"।
শেখ হাসিনার কাছে এ প্রশ্নের কোনো সদুত্তর আছে কি না জানি না, তবে উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, বায়ান্নের ভাষা আন্দোলন, একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও নব্বইয়ের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের ইতিহাস বিশ্লেষণ করে এটুকু বলা যেতে পারে যে, স্বাধীন দেশে নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর 'শ্যুট অ্যাট সাইট-এর নির্দেশ দিয়ে আড়াইশ' ছাত্র-জনতাকে হত্যার দায় নিয়ে ইতিহাস কাঁপানো এই গণআন্দোলনে হাসিনা সরকারের পতন যেন একেবারেই সুনিশ্চিত! লক্ষ-কোটি প্রতিবাদী জনতা এবার আর ঘরে ফিরবে বলে মনে হয় না বিজয় ছাড়া। এ প্রজন্মের মুক্তিযোদ্ধারা বিজয় ছিনিয়ে আনবেই আনবে; কারণ তাদের ধমণীতে প্রবাহিত একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা; যুগ যুগ ধরে যেই চেতনা লড়াকু বাঙালি জাতিকে উজ্জ্বীবিত করেছে শোষকের রক্তচক্ষুকে তোয়াক্কা না করে অধিকার আদায়ের সংগ্রামে জীবন উৎসর্গ করার সুদৃঢ় প্রত্যয়ে।
সারওয়ার-ই আলম ২রা আগস্ট ২০২৪