এক্সক্লুসিভ ২৩ জুলাই ২০২৪

গণভবনে একটি কল্পিত সংবাদ সম্মেলন : সারওয়ার ই আলম

প্রধানমন্ত্রীর কাছে ছয়টি প্রশ্ন —

post

সমগ্র বাংলাদেশটা আজ যে রকম অগ্নিগর্ভ অবস্থা, বাংলাদেশের একজন নাগরিক হিসেবে আমারও মনের অবস্থা ঠিক তাই। দেশ নিয়ে এক অসহনীয় উৎকণ্ঠা ও উদ্বেগের মধ্যে দিন পার করছি। আমার বিশ্বাস আমার মতো লক্ষ কোটি প্রবাসী বাংলাদেশীর মনের অবস্থাও তাই। রাজনীতিবিদদের একেক পর এক ভুল সিদ্ধান্তের কারণে দেশটা ক্রমশ অনিশ্চয়তার দিকে যাচ্ছে। যেন এক ঘনঘোর অন্ধকার ধেয়ে আসছে পুরো দেশটাকে গ্রাস করার জন্য। পশ্চিমাকাশে কালো মেঘের ঘনঘটা। যেন "দিকে দিকে নাগিনীরা ফেলিতেছে বিষাক্ত নিশ্বাস"। টেলিফোনে দেশের সাথে যোগাযোগ করতে পারছি না। স্বজনরা কেমন আছেন জানি না।অনলাইনে খবরের কাগজ পড়তে পারছি না। কাগজগুলো ইন্টারনেট সংযোগ না থাকায় আপডেট করতে পারছে না। এ এক অভাবনীয় জিম্মি দশা। দেশে ও প্রবাসে লক্ষ কোটি নাগরিককে এরকম জিম্মি দশায় নিপতিত করেছে বর্তমান সরকার শুধুমাত্র ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য। সরকারের এরূপ আচরণ দেখে মনের মধ্যে হাজারো প্রশ্ন ঘুরপাক খায়। 


এমতাবস্থায় যদি সুযোগ থাকতো আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে গণভবনের সংবাদ সম্মেলনে দাঁড়িয়ে একজন সংবাদকর্মী হিসেবে কয়েকটি প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতাম। প্রশ্নগুলো হলো— 

এক. প্রধানমন্ত্রী, আপনার সরকার ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করার কারণে সাধারণ মানুষ বিশেষ করে প্রবাসীরা খবরের কাগজ পড়তে পারছেন না। অপরদিকে যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ থাকার কারণে দেশের অধিকাংশ মানুষ মুদ্রণ সংস্করণ থেকেও বঞ্চিত। শুধুমাত্র সরকারী মদদপুষ্ট আমাদের সময় পত্রিকা অনলাইন আপডেট দিতে পারছে। তাহলে আপনার এই শাসনামলের সঙ্গে বাকশালের পার্থক্য কোথায়? আপনার পিতা বাকশাল গঠনের পর ১৯৭৫ সালের ৬ই জুন তাঁর পছন্দের চারটি সংবাদপত্র রেখে বাকী সব সংবাদপত্রের ডিক্লারেশন বাতিল করে দেন। এটা ইতিহাসের কালো অধ্যায় হিসেবে স্বীকৃত। তিনি মনে করেছিলেন সংবাদপত্রের কণ্ঠ রোধ করতে পারলেই জনরোষ দমাতে পারবেন। কিন্তু পারেননি। তাঁর শেষ রক্ষা হয়নি। সময়ের বিবর্তনে আপনিও ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রন করে শুধু আপনার পছন্দের খবরের কাগজ চালু রেখেছেন। আপনার কাছে আমার প্রশ্ন— আপনার কি মনে হয় এভাবে আপনি মানুষের কণ্ঠ রোধ করে নিজেকে শেষ রক্ষা করতে পারবেন?

 দুই. প্রধানমন্ত্রী, কোটা সংস্কার আন্দোলনে এ পর্যন্ত প্রায় দুইশ' শিক্ষার্থী নিহত হয়েছে। এটা সুস্পষ্ট রাষ্ট্রীয় হত্যাকাণ্ড। আপনি এখন পর্যন্ত এই হত্যাকাণ্ডের কোনো বিচার করেননি। এমতাবস্থায় আপনি কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদেরকে আলোচনার আহ্বান জানিয়েছেন। আপনার কাছে আমার প্রশ্ন— আপনার পিতাকে হত্যাকারী ফারুক, রশীদ, হুদা, ডালিমগণ হত্যাকাণ্ডের পর যদি আপনাকে তাদের সঙ্গে আলোচনার প্রস্তাব দিতো, তাহলে কি আপনি পিতার রক্তের ওপর দিয়ে হেঁটে গিয়ে খুনীদের সঙ্গে আলোচনায় বসতেন? নিশ্চয় নয়! তাহলে আজ আপনি কীভাবে আশা করেন প্রায় দুই শতাধিক সহযোদ্ধার রক্তের ওপর দিয়ে হেঁটে গিয়ে কোটা আন্দোলনকারীরা আপনার সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বসবে?

 তিন. প্রধানমন্ত্রী, আপনি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনের নামে আন্দোলনকে দমাতে টেলিফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে বিশ্ব থেকে বাংলাদেশকে বিচ্ছিন্ন করেছেন। ফলে লক্ষ কোটি প্রবাসী গভীর উৎকণ্ঠায় দিন কাটাচ্ছে। বর্তমান সময়ে আর কোনো শাসক এমনটি করেছেন বলে নজির নেই। আপনার কি মনে হয় না এটা রাষ্ট্রের নাগরিকদের সঙ্গে এক চরম অসভ্যতা?

 চার. প্রধানমন্ত্রী, কোনো নাগরিক আপনি ও আপনার সরকারের মতের বিরুদ্ধে গেলেই আপনারা তাকে 'রাজাকার' হিসেবে আখ্যায়িত করেন। আপনার কি মনে হয় না এটাও এক ধরণের অসভ্যতা?

 পাঁচ. প্রধানমন্ত্রী, আপনার শাসনামলে দেশের সংসদে কোনো প্রকৃতঅর্থে কোনো বিরোধী দল নেই। দেশের আইন ও বিচার ব্যবস্থা, শিক্ষা ব্যবস্থা, প্রশাসন, ব্যাংকিং সেক্টর ভেঙ্গে পড়েছে। সীমাহীন দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতা গ্রাস করেছে রাষ্ট্রের প্রায় প্রতিটি সেক্টরকে। কোথাও আপনার কোনো নিয়ন্ত্রন নেই কিংবা যাই হচ্ছে সবই হচ্ছে আপনার অবগতির মধ্যে। একদিকে দ্রব্যমূল্য সঙ্গতির মধ্যে না থাকায় দেশের নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ ঠিকমতো খেতে পারছে না, অন্যদিকে আপনার আনুকূল্য লাভকারীরা হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক বনে যাচ্ছেন। এই সীমাহীন দূর্নীতি নিয়ন্ত্রনে ব্যর্থতার দায় তো আপনার। আপনার কি মনে হয় না আপনার আসলে প্রধানমন্ত্রী থাকার কোনো নৈতিক অধিকার নেই। এই সীমাহীন দুর্নীতি নিয়ন্ত্রনে ব্যর্থতার দায় নিয়ে আপনার পদত্যাগ করা উচিত?

 ছয়. প্রধানমন্ত্রী, আমার সর্বশেষ প্রশ্ন হলো এই যে প্রায় দুই শতাধিক নিরস্ত্র শিক্ষার্থী তাদের গণতান্ত্রিক দাবী আদায় করতে গিয়ে হত্যার শিকার হলো, সরকারের প্রধান নির্বাহী হিসেবে এই হত্যাকাণ্ডের ' কালেকটিভ রেসপনসিবিলিটি' তো আপনার, ঠিক যেভাবে একাত্তরে রাজাকার বাহিনী গঠনের মাধ্যমে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞে গোলাম আযমকে ' কালেকটিভ রেসপনসিবিলিটির' জন্য দণ্ডিত করা হয়েছিল। তাহলে আপনার কি একবারও মনে হয় না এই দুই শতাধিক শিক্ষার্থী হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করে আপনার অবিলম্বে পদত্যাগ করা উচিত?

 প্রধানমন্ত্রী, দুঃখিত আমি আপনার সুবিধালাভের আশায় একজন নতজানু সাংবাদিক হয়ে আপনাকে 'মিরাকল লেডি' অভিধায় অভিষিক্ত করতে পারিনি, কিংবা বলতে পারিনি, ' মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনি নোবেল পুরস্কার পাওয়ার সকল যোগ্যতা অর্জন করেছেন'। আমার এই অপারগতা আপনি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। আমি শুধুমাত্র একজন সংবাদকর্মী হিসেবে বিবেকের তাড়নায় রাষ্ট্রের সতেরো কোটি নাগরিকের পক্ষে আপনার কাছে ছয়টি প্রশ্ন উত্থাপন করলাম। জবাবদিহিতার বৃহত্তর স্বার্থে আমি আপনার কাছ থেকে এসকল প্রশ্নের সুনির্দিষ্ট উত্তর চাই।

আরো পড়ুন!

Sidebar Banner
Sidebar Banner