কলাম ২২ জুলাই ২০২৪

সত্যটা জানি, দূর করি বিবেকের বন্ধ্যাত্ব ॥ সারওয়ার-ই আলম ॥

post

কোটা সংস্কার আন্দোলনের শিক্ষার্থীরা নিজেদেরকে 'রাজাকার' বলে দাবী করে ক্যাম্পাসে স্লোগান দিয়েছেন— একেবারে শুরুতে একটি মহল এই মর্মে ফেসবুকে বার্তা ছড়িয়েছেন। যার ফলশ্রুতিতে দেশজুড়ে এত কিছু ঘটে গেল। এই পর্যন্ত সারাদেশে ছয়টি তাজা প্রাণ ঝরল। কিন্তু ওই বার্তাটি যে কত বড় মিথ্যাচার ছিল তা একটু অনুসন্ধান করলেই প্রমাণিত হয়। তাহলে দেখা যাক, শিক্ষার্থীদের মূল স্লোগানটি আসলে কী ছিল। তাঁরা কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর তীর্যক মন্তব্যের প্রতিবাদ করতে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রথম যে স্লোগানটি দিয়েছিলেন, তার ভাষা ছিল এরকম— আমি কে? তুমি কে? রাজাকার! রাজাকার! কে বলেছে? কে বলেছে? স্বৈরাচার! স্বৈরাচার ! কিন্তু স্বার্থান্বেষী মহল কী করলেন? তাঁরা শিক্ষার্থীদের এই স্লোগানের প্রথম দু'টি লাইন তুলে ধরে প্রচার করলেন যে শিক্ষার্থীরা নিজেদেরকে রাজাকার বলে দাবী করছেন। স্লোগানটিতে পরে যে আরও দুটি লাইন ছিল সেটা তারা বেমালুম গায়েব করে দিলেন। এতে করে যে কারো কাছেই মনে হতে পারে যে— শিক্ষার্থীরা বুঝি আসলেই নিজেদেরকে রাজাকার বলে দাবী করছেন।


 কিন্তু পুরো স্লোগানটি শোনার পর নূন্যতম বাংলা বোঝে এমন কারো মনে আর কোনো সংশয় থাকার কথা নয়। পুরো স্লোগানটি শোনার পর পরিষ্কারভাবে যা বোঝা যায়, তাহলো— তাদের ভাষায় একজন 'স্বৈরাচার' তাদেরকে রাজাকার বলে আখ্যায়িত করেছেন, যে কারণে তারা বলছেন- "আমি কে তুমি কে রাজাকার রাজাকার, কে বলেছে? কে বলেছে? স্বৈরাচার! স্বৈরাচার ! — এখানে স্বৈরাচার বলতে তারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ইঙ্গিত করছেন। এই স্লোগানের পরে আরও একটি স্লোগান ছিল যেটি শুনলে তাদের বক্তব্য আরও পরিষ্কারভাবে ফুটে ওঠে। কী ছিল ওই স্লোগানটি? ওই স্লোগানটি ছিল এরকম— চেয়েছিলাম অধিকার হয়ে গেলাম রাজাকার কী পরিষ্কার বক্তব্য! কোথাও কোনও অস্পষ্টতা নেই। অথচ একটি মহল কী করল? তারা ছয় লাইনের স্লোগানের মধ্য থেকে বেছে বেছে শুধু দুটি লাইন প্রচার করল! ব্যস স্বার্থ হাসিল! আগুন ছড়িয়ে পড়ল সারাদেশে!

 এখানে প্রশ্ন জাগতে পারে শিক্ষার্থীদের স্লোগানের 'খণ্ডিত অংশ'কে উপস্থাপন করে তাদেরকে এভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী বানিয়ে দেয়ার কারণ কী? এটা তো একেবারে জাতির মুখোমুখি তাদেরকে দাঁড় করিয়ে দেয়ার সামিল। শিক্ষার্থীরা নিজেদেরকে রাজাকার বলে দাবী করা, আর তাদেরকে কেউ রাজাকার বলে আখ্যায়িত করলে তার বক্তব্যের প্রতিবাদে রাজাকার শব্দটি ব্যবহার করা মোটেই এক কথা হতে পারে না। বাংলা ভাষায় নূন্যতম জ্ঞান আছে এরকম যে কেউই তাদের স্লোগানের মর্মার্থ বুঝবেন। এটা বোঝার জন্য ভাষাবিদ হওয়ারও কোনো দরকার নেই। পুরো ঘটনাটা দেখে আমার মনে হয়েছে একেবারে অন্যায়ভাবে লাখো শিক্ষার্থীদের গায়ে 'এরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী'—এই কালিমা লেপন করার অপচেষ্টা চালানো হয়েছে। এটা জঘণ্য রকমের রাজনৈতিক অসততা। রাজনীতিবিদদের ভয়ংকর কূটকৌশল। দেখে খুবই কষ্ট লাগছে যে সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা প্রথিতযশা রাজনীতিবিদদের এরকম জঘন্য কূটকৌশলের নির্মম শিকার। সবচেয়ে বেশী বিস্মিত হয়েছি অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবালের বক্তব্য পড়ে। তিনি নিজেও শিক্ষার্থীদের স্লোগানের খণ্ডিত অংশটিকে তুলে ধরে ভুল ব্যাখ্যা দাঁড় করালেন। বিভিন্ন মাধ্যমে তাঁর হাতে লেখা একটি নিবন্ধের অংশবিশেষ ঘুরপাক খাচ্ছে। এতে তিনি লিখেছেন, “ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমার বিশ্ববিদ্যালয়, আমার প্রিয় বিশ্ববিদ্যালয়।

 তবে আমি মনে হয় আর কোনোদিন এই বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে চাইব না, ছাত্র ছাত্রীদের দেখলেই মনে হবে, এরাই হয়তো সেই রাজাকার! “ কী ভয়ংকর ব্যাখ্যা চিন্তা করা যায়! একজন শিক্ষক কতটা বুদ্ধি প্রতিবন্ধী হলে একটি স্লোগানের অংশ বিশেষকে তুলে ধরে এরকম অপব্যাখ্যা দাঁড় করাতে পারেন। তাঁর বক্তব্যটি পড়ে রীতিমত স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। এত বড় দেশ বরেণ্য একজন শিক্ষাবিদ বাংলা ভাষায় উচ্চারিত একটি স্লোগানের যে ব্যাখ্যা দাঁড় করালেন এতে করে তাঁর ভাষাজ্ঞান নিয়েই তো রীতিমত প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। দেশে কর্মরত সাংবাদিকদের কাছে অনুরোধ জানাই, আপনারা দয়া করে কেউ উদ্যোগী হয়ে এই অধ্যাপককে একটু জিজ্ঞেস করুন, স্যার, আমি কে? তুমি কে? রাজাকার! রাজাকার! কে বলেছে? কে বলেছে? স্বৈরাচার! স্বৈরাচার !— এই স্লোগান শুনে কী করে আপনার মনে হলো যে ওরা নিজেদেরকে রাজাকার বলে দাবী করছে? আপনি কি তাদের স্লোগানের পরের দুটি লাইন শোনেননি না শোনার দরকার মনে করেননি? শিক্ষার্থীদের স্লোগানের অপব্যাখ্যা দাঁড় করানোর ফলে আমরা কী দেখলাম? আমরা দেখলাম— ছাত্রলীগ বর্বরোচিতভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর।কী নির্মম সেই ঝাঁপিয়ে পড়া! নিরস্ত্র শিক্ষার্থীদেরকে অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে নির্বিচারে আঘাত করছে তারা। রক্তাক্ত হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। জীবন বাঁচাতে রক্তাক্ত অবস্থায় এদিক সেদিক ছোটাছুটি করছেন ছাত্র-ছাত্রীরা। পরে শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। দেশের বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছড়িয়ে পড়ে তাদের এই আন্দোলন।

 শোনা যাচ্ছে ছাত্রলীগ ও পুলিশের আক্রমণে এই পর্যন্ত ছয় ছয়টি ছাত্রের লাশ পড়েছে। সারাদেশের ছাত্রসমাজ প্রতিবাদে ফুঁসছে। বাঁধভাঙ্গা ঢেউয়ের মত দলে দলে শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের হল থেকে রাজপথে নেমে আসছেন। তীব্র সাহসে বুক চেতিয়ে দিচ্ছেন পুলিশের বন্দুকের গুলির কাছে! কোটা সংস্কার নিয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন কতটা যৌক্তিক সেটা নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে বিস্তর যুক্তি থাকতে পারে। রাষ্ট্রের একজন নাগরিক হিসেবে ব্যক্তিগতভাবে আমার নিজেরও মনে হয় পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে সামনে এগিয়ে আনার জন্য কিছু কোটা থাকা দরকার আছে। এখন সেটা কত ভাগ থাকবে, এই কোটা ব্যবহার করে দলীয়কর্মীদের চাকুরীতে নিয়োগ দেয়ার অপকৌশল বা অপচর্চা কীভাবে বন্ধ করা হবে— সেটা নির্ধারণ করবে সরকার-প্রশাসন। বিষয়টি নিয়ে সংস্লিষ্ট মহলের সঙ্গে আলোচনা বা পরামর্শসভা হতে পারে। বিষয়টি নিয়ে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলোচনা করে সমস্যাটির সমাধান করার চেষ্টা করাটা মোটেই কঠিন ছিল বলে মনে হয় না। শুধু দরকার ছিল রাজনৈতিক বিচক্ষণতা। অধিকার বা দাবী আদায়ের জন্য আন্দোলন মানুষ করবেই। এটা নাগরিক অধিকার। কিন্তু সেই আন্দোলন দমন করার দায়িত্ব নিশ্চয় ছাত্রলীগের নয়। তারা দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও নয় কিংবা তাদের বিকল্পও নয়। সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালিয়ে তারা যে দেশের আইন লংঘন করেছে এটা কি সরকার দেখছেন না? পুলিশ বাহিনী দেখছেন না? দেখে থাকলে এই অপরাধীদের বিচার কই? আমরা শুনি দেশে আইন তার নিজের গতিতে চলে।

 কিন্তু বাস্তবে কী দেখছি? এই ঘটনায় আমরা লক্ষ করছি আইন তার নিজের গতিতে তো চলছেই না, বরং আইন চলছে ছাত্রলীগের গতিতে। একটা জাতির জন্য এরচেয়ে চরম দুর্ভাগ্য আর কী হতে পারে! তাই সরকারকে কঠোর হাতে ছাত্রলীগকে দমন করতে হবে। সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠনের কর্মীদের সশস্ত্র হামলার দায়িত্ব কিন্তু দলটির প্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপরই বর্তায়। আমাদের দেখার পালা তিনি ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে এই ঘটনায় আদৌ কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ করেন কি না! আর করলে কী ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। একটি ছাত্র সংগঠন এতটা ক্ষমতাধর, এতটা হিংস্র, এতটা বেপরোয়া হয়ে ওঠা কখনোই কাম্য হতে পারে না। একইসঙ্গে শুধুমাত্র রাজনৈতিক মতপার্থক্যের কারণে সাধারণ জনগনের গায়ে যখন তখন 'রাজাকার' এর তকমা ঝুলিয়ে দেয়ার অসুস্থ প্রবণতা বন্ধ করতে হবে। তরুণ প্রজন্মের লাখো লাখো শিক্ষার্থীকে রাজাকার বলে আখ্যায়িত করার আগে দ্বিতীয়বার চিন্তা উচিত তাদের সঙ্গে কত বড় অন্যায় করা হচ্ছে। এই অন্যায় দেশের সাধারণ মানুষ কখনোই বরদাশত করবেন না! আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ যত দ্রুত এটি উপলব্ধি করেন ততই দলটির জন্য মঙ্গল। তা না হলে সেদিন মনে হয় বেশী দূরে নয় যেদিন তাদেরকে এর জন্য কঠিন মূল্য দিতে হবে!! 

ইলফোর্ড, লণ্ডন ১৬ই জুলাই ২০২৪

আরো পড়ুন!

Sidebar Banner
Sidebar Banner