বিশেষ অনুষ্ঠান ১৮ নভেম্বর ২০২৩

লন্ডনের শহীদ আলতাব আলীর ৪৫তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে নির্মিত বিশেষ তথ্য চিত্র | Altab Ali ( ভিডিও লিংক সহ )

post

 ভিডিও লিংক | https://youtu.be/pknzgAFiZyU
প্রতিবছর  ৪ মে আসে ব্রিটেন প্রবাসী বাংলাদেশিদের  হৃদয়ে শোক আর কষ্টের দীর্ঘশ্বাস হয়ে।এদেশে অবস্থানরত  বাংলাদেশিদের জন্য বেদনাবিধুর ও বিভীষিকাময় দিন এটি ।১৯৭৮ সালের এই দিনে বর্ণবাদীদের নির্মম হামলায় নিহত হন আলতাব আলী।রচিত হয় ইতিহাসের এক কলঙ্কিত অধ্যায়।সূচনা হয় দিন বদলের পালা। সেদিন থেকে ঐক্যবদ্ধভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রতিজ্ঞা করে দ্বিধা বিভক্ত  যুক্তরাজ্য অভিবাসী বাংলাদেশিরা।বলা হয় ১৯৭৮ সালের ৪ মে ছিল এদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশিদের টার্নিং পয়েন্ট 


১৯৭৮ সালের ৪ মে।সে দিন ছিল স্থানীয় সরকার নির্বাচন।কাজ শেষে বাজার করে  বাসায় ফেরার পথে পূর্ব লন্ডনের এডলার স্ট্রিটে বর্ণবাদীর হাতে ২৪   বছর বয়স্ক আলতাব আলী নির্মমভ    

 সেদিন আলতাব আলীর উপর  ছুরি চালায় ন্যাশনাল ফ্রন্টের  তিন শ্বেতাঙ্গ  কিশোর।তারা আলীকে চিনতো না।ভিন্ন বর্ণের মানুষ বা  অভিবাসীদের মারাই ছিল তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।সে সময় ব্রিটেনে অবস্থানরত বাংলাদেশিদের জীবনের প্রতিটা মুহূর্ত ছিল ভীষণ ঝুঁকিপূর্ণ।

 এর আগে বো এলাকায় তসির আলী নামে  একজন বাংলাদেশিকে হত্যা করে বর্ণবাদীরা।১৯৭৮ সালের  জুন মাসে হ্যাকনি রোডে ইশহাক আলি নামে  আরো  এক বাংলাদেশি বর্ণবাদী হামলায় প্রাণ হারায় ।মজার ব্যাপার হলো বর্ণবাদীদের এ সব নাশকতা চলতো  প্রকাশে। কারণ পুলিশ তাদের কিছুই বলতো না। 

 

আলতাব আলীর মৃত্যুর দশ দিন পর, বর্ণবাদের বিরুদ্ধে হাজার হাজার মানুষ তাঁর কফিন নিয়ে মিছিল করে।প্রথমে তারা যান লন্ডনের রাজপথ ধরে। কফিন কাঁধে মিছিল হাইড পার্ক, ট্রাফালগার স্কয়ার এবং ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন ১০ ডাউনিং স্ট্রিটে পৌঁছায়।সেদিন ঐ বিশাল জনতার কণ্ঠে ছিল  “কৃষ্ণাঙ্গ- শ্বেতাঙ্গ এক হও এবং লড়ো” – “ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট- ইউনাইট এন্ড ফাইট।” এই গণবিস্ফোরণ যুক্তরাজ্য বর্ণবিদ্বেষী অবস্থার ভীত নড়বড়ে করে তোলে ।
মৃত্যুর এক মাস পর, দেশে  আলতাব আলীর  গ্রামের বাড়িতে  পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।

১৯৫৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি  আলতাব আলী সিলেটের মোল্লাআতা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।বাবা হাজী আব্দুস সামাদ ও মা সোনাবান বিবি। তিন ভাই ও চার বোনের মধ্যে আলতাব আলী ছিলেন সবার বড়।তিনি লেখাপড়া করেছেন মুল্লাআতা প্রাথমিক বিদ্যালয়,  গোবিন্দগঞ্জ বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় ও সিলেটের মদনমোহন কলেজ থেকে।

১৯৬৯ সালে   আলতাব আলী  পাড়ি জমান বিলেতে।লন্ডনের ওয়াপিং এলাকার  রেয়ার ডন স্ট্রিটে  ফুফাতো ভাই আবুল হোসেনের সঙ্গে একই বাসায়  বসবাস করতেন তিনি ।বস্ত্র শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন  বাংলা টাউনের  ব্রিকলেন সংলগ্ন হানবুরি স্ট্রিটের একটি পোশাক কারখানায়  ।

১৯৭৫ সালে আলতাব আলী  প্রথমবারের মতো  দেশে যান।বিয়ে করেন জাহানারা বেগমকে ।এর পর জীবিকার তাগিদে আবার  ফিরে আসেন লন্ডনে।তার স্বপ্ন ছিল মা ও ছোট ভাই বোনকে  অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করে তুলবেন।জীবন সঙ্গীকে নিয়ে আসবেন লন্ডনে।কিন্তু তার সে স্বপ্ন আর পূরণ হয়নি।ঘাতকের ছুরিকাঘাতে নির্মম ভাবে প্রাণ হারান ব্রিটেনের  অভিবাসী  ইতিহাসের বাঁক-ঘোরানো এই  সিংহপুরুষ।
আগে পরে শারীরিক ও মানসিক নানা  অত্যাচার অবিচার হত্যা নীরবে সহ্য করলেও আলতাব আলী হত্যার পর অভিবাসীরা বুঝতে পেরেছিলো যে, শুধু আলোচনা, সমালোচনা ,মিটিং মিছিল প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ করে এদেশে  বাঁচার অধিকার প্রতিষ্ঠা করা যাবে না।অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হলে আন্দোলনের পাশাপাশি পৌঁছাতে হবে  নীতিনির্ধারক পর্যায়ে ।এই চিন্তা থেকে শুরু হয়   ব্রিটেনে মূলধারার রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হবার নতুন পথ চলা।

)অবশেষে নব্বইয়ের দশকে অভিবাসী বাংলাদেশিদের দুর্বার আন্দোলন ও নানামুখী চাপের মুখে পুলিশ ও প্রশাসন বর্ণবাদ মোকাবেলায় সক্রিয় ভূমিকা নিতে বাধ্য হয়।কমে আসে সহিংসতা।যার সুফল এখনও ভোগ করছে এ দেশে অবস্থানরত প্রতিটি অভিবাসী।

 সেদিনের সেই সংগ্রামে বাংলাদেশিদের পাশে ছিলেন যুক্তরাজ্যের নিরীহ শ্বেতাঙ্গ, পাকিস্তানি, ভারতীয়, ক্যারিবীয় সকলেই।এ ছাড়া আরো ছিল বামপন্থী বর্ণবাদ বিরোধী সংগঠন এস ডাবলু পি এবং এন্টি নাৎসি লীগ।
১৯৯৮ সালে আলতাব আলী  হত্যাকাণ্ডের স্থান সেন্ট মেরিস পার্ককে 'শহীদ আলতাব আলী পার্ক' নামে নামকরণ করা হয়।১৯৯৯ সালে আলতাব আলী পার্কের দক্ষিণ প্রান্তে প্রতিষ্ঠা করা হয়  একটি শহীদ মিনার।পরবর্তীতে আলতাব আলী পার্ক সংলগ্ন বাস স্টপের নামকরণও করা হয়  কালের সাক্ষী এই মানুষটির নাম।  

প্রতি বছর ৪ মে  আলতাব আলী দিবস সহ বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে শহীদ আলতাব আলীকে স্মরণ করা হয় ব্রিটেনে ।ঐ দিন টাওয়ার হ্যামলেটের নির্বাহী মেয়র,লন্ডনস্থ হাইকমিশনের উর্দ্ধতম কর্মকর্তা,স্থানীয় এমপি ,আলতাব আলী ফাউন্ডেশন, আলতাব আলী মেমোরিয়াল ট্রাস্টের কর্মকর্তা ,সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী ও সমাজের সকল শ্রেণীর মানুষ আলতাব আলী পার্কের শহীদ বেদিতে ফুল দিয়ে শহীদ আলতাব আলীর প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন।এছাড়া মঞ্চায়িত হয় নাটক।বিভিন্ন  টিভি চ্যানেল থেকে প্রচারিত হয় বিশেষ অনুষ্ঠান। সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয় বিশেষ ক্রোড় পত্র। 
 
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেল ব্রিটেনে এতো কিছু হলেও  আলতাব আলীর জন্ম স্থান সিলেটের মোল্লাআতা গ্রামে অবহেলা আর অনাদরে পড়ে আছে জরাজীর্ণ আলতাব আলীর বাসস্থান ।যেখানে তিনি ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন।কেটেছিল শৈশব কৈশোর ও যৌবনের একটা বিরাট  অংশ।তার পরিবারের বাকি সদস্যরাও  বসবাস করছে দরিদ্র সীমার নিচে। ঢাকা শহর তো দূরের কথা সিলেটের কোথাও  তার নাম গন্ধের ন্যূনতম কোনো চিহ্ন নেই।কেউ চেনেনা তাকে।জানে না প্রবাসে বাংলাদেশিদের আত্মপরিচয়ের পথ সুগম করা কালের সাক্ষী এই মানুষটির নাম । তবে কি আলতাব আলীকে  জানবে না দেশের আগামী প্রজন্ম ? আলতাব আলীর ইতিহাস  জানার কথা ছিল গোটা জাতির।কিন্তু, সে ইতিহাস সীমাবদ্ধ রইলো শুধু যুক্তরাজ্যে। ................এ লজ্জা কার ?

আরো পড়ুন!

Sidebar Banner
Sidebar Banner