কমিউনিটি ২৬ জুন ২০২৫

‘অখণ্ড বাংলাদেশ আন্দোলন’ এর উদ্যোগে “পলাশী ট্র্যাজেডি ও আজকের বাংলাদেশ" শীর্ষক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত

post

লন্ডন, ২৪ জুন- ঐতিহাসিক পলাশী দিবস উপলক্ষ্যে গত ২৩ জুন, সোমবার, বিকাল ৫.০০ ঘটিকায় ‘অখণ্ড বাংলাদেশ আন্দোলন’ এর উদ্যোগে লন্ডন বাংলা প্রেস ক্লাব মিলনায়তনে "পলাশী ট্র্যাজেডি ও আজকের বাংলাদেশ" শীর্ষক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। 

আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন কবি আহমেদ ময়েজ, স্বাগত বক্তব্য রাখেন অখণ্ড বাংলাদেশ আন্দোলনের আহবায়ক হাসনাত আরিয়ান খান এবং মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিশিষ্ট গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব শামসুল আলম লিটন। 

এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সাপ্তাহিক সুরমা’র প্রধান সম্পাদক ফরীদ আহমেদ রেজা এবং বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ সৈয়দ মামনুন মোর্শেদ ও অধ্যাপক আবদুল কাদির সালেহ। 

অতিথি হিসেবে কানাডা থেকে আলোচনা সভায় ভার্চুয়ালি অংশ নেন লেখক ও ইতিহাস গবেষক অধ্যাপক ড. তাজ হাশমী। 

আলোচনায় আরো অংশ নেন দৈনিক সিলেটের ডাক সম্পাদক নজরুল ইসলাম বাসন, সাবেক কাউন্সিলর লেফটেন্যান্ট (অব:) ইমরান আহমেদ চৌধুরী, স্পেকট্রাম রেডিও ইউকের পরিচালক মিছবাহ জামাল, গবেষক ড. কামরুল হাসান, দৈনিক আমার দেশ এর নির্বাহী সম্পাদক (আবাসিক) অলিউল্লাহ নোমান, লেখক ও গবেষক শেখ আখলাখ আহমেদ, সাংবাদিক ও কমিউনিটি অ্যাক্টিভিস্ট বদরুজ্জামান বাবুল, ইন্জিনিয়ার মুগনি চৌধুরী ও মানবাধীকার কর্মী হাসনাত হাবীব প্রমূখ।

সভা সঞ্চালনা করেন সাপ্তাহিক সুরমা’র ব্যবস্থাপনা সম্পাদক মিনহাজুল আলম মামুন ও সানরাইজ টুডে সম্পাদক এনাম চৌধুরী।

স্বাগত বক্তব্যে হাসনাত আরিয়ান খান অখণ্ড বাংলাদেশ আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত পটভূমি তুলে ধরেন এবং নবাবী বাংলা ফিরে পেতে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার ওপর জোর দেন। তিনি বলেন, “এ মাটি আমার, এ মাটি আপনার। এ মাটি আমাদের সবার। আমরা ছেড়ে দিবো না এ মাটির অধিকার। তিনি আরও বলেন, “প্রকৃতপক্ষে পলাশীর প্রহসনের যুদ্ধে বাংলার নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা একা পরাজিত হননি, পরাজিত হয়েছিলো বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার জনগণ। এই পরাজয়ের গ্লানি আমাদের মুছতে হবে।”  তিনি পলাশী ট্র্যাজেডি থেকে শিক্ষা নিয়ে ২০২৪ এর জুলাই গণবিপ্লবকে বেহাত হওয়া থেকে রক্ষা করার উপর গুরুত্বারোপ করেন। 

মূল প্রবন্ধে শামসুল আলম লিটন বলেন,  “আজ ২৩ জুন, এই তারিখটি আমাদের জীবনে একটি কলঙ্কিত দিন। এই দিনে আমাদের স্বাধীনতা সূর্য অস্তমিত হয়। শুরু হয় দাসত্বের এক দীর্ঘ অন্ধকার অধ্যায়। নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা একজন অল্পবয়সী, সাহসী, স্বাধীনচেতা শাসক ছিলেন। তিনি ছিলেন বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব যিনি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্র ও লুটতরাজের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। কিন্তু তিনি মীর জাফরের বিশ্বাসঘাতকতা ও দেশীয় কিছু ষড়যন্ত্রকারীদের ষড়যন্ত্রে। এটি ছিলো বিদেশি শক্তির সঙ্গে দেশীয় বেঈমানদের যুগলবন্দির এক ঐতিহাসিক ষড়যন্ত্র। পলাশীর যুদ্ধ শুধু একটি পরাজয় ছিলো না, এটি ছিলো আমাদের জাতীয় আত্মমর্যাদার পরাজয়। কিন্তু এর পেছনে কিছু বাস্তব কারণও ছিলো যা আমাদের উপলব্ধি করতে হবে। একদিকে ব্রিট্রিশরা তখন আধুনিক যুদ্ধ সরঞ্জাম ও  গোলাবারুদের যুদ্ধ শক্তি নিয়ে নামছিলো। বারুদের বন্দুক, কামান, সমন্বিত বাহিনী, আর্ন্তজাতিক কুটনীতি সব ছিলো তাদের পক্ষে। অথচ নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার বাহিনী তখনও ছিলো ঘোড়া ও তলোয়ার নির্ভর। এমনকি তাঁর কামানের গোলাগুলি বৃষ্টিতে ভিজে গিয়ে ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছিলো। মাত্র একটি ত্রিপাল না থাকায়...ভাবুন একটি সামান্য কাপড়ের অভাবে ইতিহাস কিভাবে বদলে যায়! প্রিয় ভাইয়েরা আজকের বাংলাদেশও কি তেমন বিপদের মুখোমুখি নয়? আমরা কি আরেকটি পলাশীর মুখোমুখি হচ্ছি না? আজও কি কিছু সুবিধাবাদী দেশীয় গোষ্ঠী বিদেশি শক্তির সমর্থনে আবার এই জাতিকে পরাধীনতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে না? আজও আমরা প্রযুক্তিতে ও সামরিক দুরদর্শীতায় এবং কুটনৈতিক প্রজ্ঞায় পিছিয়ে আছি। আমাদের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংসপ্রাপ্ত। প্রশাসনে দুর্নীতি, শিক্ষায় নৈতিকতার অভাব, বিচার ব্যবস্থায় পক্ষপাত, সবকিছু মিলে আমাদের একটানা অবক্ষয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। আমরা ভুলে যাচ্ছি পলাশী শুধু ইতিহাস নয়, পলাশী এক চেতনার নাম। পলাশী একটি জাতীয় চেতনা, জাতীয়তাবোধের চেতনা, স্বাধীনতা ও আত্মমর্যাদার চেতনা। আমরা যদি সিরাজ-উদ-দৌলার মত তরুণ নেতৃত্ব গড়তে না পারি, যদি মীর জাফরদের মত বিশ্বাসঘাতকদের চিহ্নিত করতে না পারি, যদি প্রযুক্তি জ্ঞান, ইমান ও বিশ্বাসের সমন্বয়ে জাতিকে গড়তে না পারি, আত্মমর্যাদায় বলিয়ান হতে না পারি, তবে আমাদের পরিণতি পলাশীর পুনরাবৃত্তির দিকেই যাবে। আজকের এই দিনে আমরা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে শপথ করি, আমরা আর কোন মীরজাফর তৈরী হতে দিবো না, আমরা আবার গড়ে তুলবো একটি বিশ্বাস নির্ভর, প্রযুক্তি নির্ভর, আত্মমর্যাদা সম্পন্ন একটি জাতি। আসুন সবাই মিলে জাতীয়তাবাদ, মূল্যবোধ ও মুক্তচিন্তা নিয়ে নতুন বাংলাদেশ বা অখণ্ড বাংলাদেশ, যে বাংলাদেশের স্বপ্ন আমরা দেখি তা গড়ে তুলি। নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার অসমাপ্ত কাজকে আমরা সম্পন্ন করবো ইনশাআল্লাহ।”

অতিথি হিসেবে আলোচনা সভায় ড. তাজ হাশমী বলেন, “পলাশী যুদ্ধে তথ‌্য ও প্রযু‌ক্তি, রণ‌কৌশল, সিপাহশালার‌দের বেঈমানী - বড় দাগে ছি‌লো বিশ্বা‌সের ঘাট‌তি। সেনাপ্রধা‌ন মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতা, এর স‌ঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলো বাকী সব ব‌্যবস্থাপনা। তিনি আরো বলেন, “আমরা যেভাবে ইতিহাসটা পড়ি তার প্রভাব পড়েছে আমাদের চিন্তাধারায়। আমাদের দেশে যার ডাক্তারী, ইন্জিনিয়ারিং, ইকোনোমিস্ট পড়বের তার সাথে ইতিহাসের পরিচয় হয় না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ব্রিটেন বলেন, সেখানে তাদের দেশের ইতিহাস ও পৃথিবীর ইতিহাস, বিশেষ করে ইউরোপের ইতিহাস, ফরাসী বিপ্লবের ইতিহাস এবং বিংশ শতাব্দীর ইতিহাস অবশ্য পাঠ্য। আমাদের দেশের মেডিকেল পড়ুয়ারা বলবে আমি ডাক্তারী পাশ করবো, আমি আবার ইতিহাস পাঠ করবো কেনো?” তিনি দেশের মানুষের ইতিহাস চর্চার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে শিক্ষাবিদ সৈয়দ মামনুন মোর্শেদ বলেন, “পৃথিবীর ইতিহাসের জঘন্যতম বিশ্বাসঘাতকতার সাক্ষী হয়ে আছে পলাশীর যুদ্ধ। আর এই ষড়যন্ত্রের কুশীলব ছিলেন নবাবের প্রধান সেনাপতি মীর জাফর। সাথে ছিলো জগৎশেঠ, ঘষেটি বেগম, রাজ বল্লভ, ইয়ার লতিফ ও উমিচাঁদ গংরা। কোন বাঙালিই তার সন্তানের নাম “মীর জাফর” রাখে না। নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার চরিত্রে কালিমা লেপনের চেষ্টা করেও পারা যায়নি। নানা গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, তিনি ছিলেন সত্যিকারের দেশপ্রেমিক, প্রজাবৎসল নবাব। চরম বাঙালি বিদ্বেষী বর্ণবাদী রবার্ট ক্লাইভের কুটচাল এবং কিছু বিশ্বাসঘাতকের গভীর ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে পলাশীর প্রান্তরে তাঁর পতনের মধ্যে দিয়ে বাংলার স্বাধীনতা সূর্যের অস্ত ঘটে। একইসঙ্গে পুরো উপমহাদেশে সাম্রাজ্যবাদের পথ মসৃণ হয়ে যায়। সেদিন যদি সবাই সিরাজের পাশে থেকে ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই করতেন, তাহলে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা আজ আলাদা হতো না। হাসনাত আরিয়ান খানের মত তরুণেরা নবাবী বাংলা ফিরে পেতে আন্দোলন করছে। অখণ্ড বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখছে। একদিন তাদের স্বপ্ন সফল হবে। আমি তাদের সফলতা কামনা করি।”

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে অধ্যাপক আবদুল কাদির সালেহ বলেন, “১৭৫৭ সাল থেকে আজকে ২০২৫ সাল, পলাশীর যে ট্র্যাজেডি, তার যে শিক্ষা তা আজও কিন্তু সমানভাবে আমাদের জন্য প্রযোজ্য। সেজন্যই বার বার পলাশী আমাদের কাছে প্রাসঙ্গিক হয়ে আসে। তার আলোচনা খুব জরুরি হয়ে ওঠে। সেই সময় ৮০০ বছরের সাম্রাজ্যের কেনো পতন হলো এবং কী কারণে আমরা আমাদের স্বাধীনতা ধরে রাখতে পারিনি, এর পেছনে কী কী কারণ ছিলো, এই কারণগুলো অনুসন্ধান করে তার ভিত্তিতে যদি আমরা আমাদের চিন্তা, চেতনা, জাতীয়তা, আমাদের সংস্কৃতি আমরা যদি নির্মাণ করতে পারি তাহলে আমরা আবার স্বাধীন সত্তা নিয়ে দাঁড়াতে পারবো। সে কারণে পলাশীর আলোচনা, পলাশী দিবসকে চেতনার একটা দিবস হিসেবে নির্মাণ করা অত্যাবশ্যক এবং জরুরি। আমি এটা মনে করি। এক ধর‌নের চেতনা থে‌কে বি‌ভিন্ন বয়ান তৈরী হয়। এসব বিকৃত বয়ান বা চেতনা‌কে চ্যা‌লেঞ্জ কর‌তে হ‌বে। তবেই ই‌তিহাস পুনরাবৃত্ত হবে।”

প্রধান অতিথির বক্তব্যে ফরীদ আহমেদ রেজা বলেন, “আমাদের বসে থাকলে চলবে না। আমাদের নতুন প্রজন্ম যারা আছে, যারা ইতিহাস বিস্মৃত, তাদেরকে ইতিহাসের সাথে সম্পৃক্ত করতে হবে। আরো বড় পরিসরে করতে হবে। তবে শুরু করার জন্য আমি অখণ্ড বাংলাদেশ আন্দোলন এর আহবায়ক হাসনাত আরিয়ান খানকে ধন্যবাদ জানাই। তার কারণেই আজকে আমরা এই সমাবেশে জড়ো হতে পেরেছি। বিজ্ঞ আলোচকদের অনেক মূল্যবান কথা শুনে আমরা সমৃদ্ধ হয়েছি। যখন জুলাই বিপ্লব হলো তারা যখন শ্লোগান দিলো আবু সাঈদ মুগ্ধ শেষ হয়নি যুদ্ধ, তখন আমি ঢাকায় যারা উপদেষ্টা হয়েছেন তাদের কয়েকজনকে আমি ওইদিন একটা মেসেজ দিয়েছিলাম। আমি তাদেরকে বলেছিলাম একথা যে আপনার যদি বিপ্লবী সরকার গঠন না করেন, আপনারা যদি চুপ্পুকে না সরান তাহলে বিপ্লব হাত ছাড়া হয়ে যাবে। পৃথিবীতে অনেক বিপ্লব হাতছাড়া হয়েছে। সুতরাং আমরা চাইনা এটা হাতছাড়া হোক। মীরজাফর প্রথমবার যখন বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলো, নবাব যদি তখন তার বিরুদ্ধে কঠোর হতেন তাহলে মীরজাফরসহ বাকিরা আর বিশ্বাসঘাতকতা করার সাহস পেতো না। ২৪ এর বিপ্লবের সাথে যারা বিশ্বাসঘাতকতা করবে তাদের বিরুদ্ধে আমাদেরকে কঠোর হতে হবে। মোহনলাল, মীর মদনরা নবাবের জন্য প্রাণপণ লড়াই করে জীবন দিয়েছিলেন পলাশীর যুদ্ধে। এটা আমাদের মনে রাখতে হবে। আমাদেরকে একসাথে আবার লড়তে হবে। আমাদের নতুন প্রজন্ম‌কে এসব ভাবনার সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে হ‌বে। বাংলার প্রশাস‌নিক দুর্বলতা, সাম্প্রদা‌য়িক উপাত্ত‌কে চি‌হ্নিত কর‌তে হ‌বে।“ 

দৈনিক সিলেটের ডাক এর সম্পাদক নজরুল ইসলাম বাসন বলেন, “আজ ঐতিহাসিক পলাশী দিবস। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর প্রান্তরে, স্বল্প সময়ের একটি ছোট যুদ্ধের মাধ্যমে শুরু হয় পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম দীর্ঘ ও ভয়াবহ অর্থনৈতিক লুন্ঠনের এক অধ্যায়। শুধু বাংলার স্বাধীনতা নয়, হারিয়ে যায় এর অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, সাংস্কৃতিক আত্মমর্যাদা এবং রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ। পলাশীর যুদ্ধ ছিল আসলে একটি ষড়যন্ত্রমূলক অভ্যুত্থান, যার পেছনে ছিল ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি—বিশ্বাসঘাতক মীর জাফরদের মতো দেশীয় সহযোগীদের সঙ্গে নিয়ে। বর্তমান সম‌য়েও আমরা প্রায় ইতিহাসের একই প্লাটফ‌র্মে ঘুর‌ছি। য‌দি জুলাই গণঅভ‌্যুত্থা‌নে জেনজি প্রজন্ম আবাবি‌ল পাখির ম‌তো বে‌রি‌য়ে না আস‌তোম, তাহ‌লে নতুন ক‌রে ভাবার অবকাশ আমরা পেতাম না। জুলাই গণবিপ্লবকে যেকোনো মূল্যে রক্ষা করতে হবে।”

স্পেকট্রাম রেডিও ইউকের পরিচালক মিছবাহ জামাল বলেন, “ইতিহাসের পরতে পরতে আমরা যেসব ভুল করেছি, সেসব ভুল থেকে আজো আমরা বের হয়ে আসতে পারিনি। ইতিহাস থেকে যদি শিক্ষা না নেওয়া হয়, তবে তা বারবার ফিরে আসে ভিন্ন রূপে। আজকের বাংলাদেশ যদি সত্যিকারের অর্থে তার সকল খণ্ডের স্বাধীনতা চায়, হাত-পাগুলো যুক্ত করতে চায়, তাহলে অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক স্বাধীনতার জন্যও সংগ্রাম করতে হবে এবং সেই সংগ্রামের প্রেরণা হতে পারে পলাশী।

গবেষক ড. কামরুল হাসান বলেন, “আমাদের ইতিহাসকে আমরা এত বেশি আড়ালে রাখি.. যেন ভুলেই গেছি! অথচ এগুলো বেশি বেশি চর্চিত হবার বিষয়! ইতিহাস যখন আমরা চর্চা করি তখন নতুন জিনিস আমরা আনতে পারি না। আজকের এই বিয়োগান্তক দিনে আওয়ামী লীগের জন্ম। তারা পলাশী দিবস পালন করে না। তারা তাদের দলের জন্ম উৎসব করে। আজও তারা  উৎসব করছে। ইতিহাস নিয়ে আমাদের বহুমাত্রিক বিশ্লেষণ করতে হবে। ইতিহাস চর্চা করতে হবে।”

লেখক শেখ আখলাখ আহমেদ ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরে এম আর আখতার মুকুলের পঠিত চরমপত্র শোনার পরামর্শ দিয়ে বলেন, “ন্যারেটিভ জিনিসটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। ৭১ এর পরে অনেক বয়ান তৈরী হয়েছিলো। কিন্তু ২৪ এর জুলাই বিপ্লবের পরে কোন বয়ান তরী হয়নি। পলাশীর পরেও কোন বয়ান তৈরী হয়নি। আমরা বয়ান তৈরীতে ব্যর্থ হয়েছি। আমাদেরকে ন্যারেটিভ তৈরী করতে হবে।”

সাবেক কাউন্সিলর লেফটেন্যান্ট (অব:) ইমরান আহমেদ চৌধুরী বলেন, “পলাশীর যুদ্ধ, এটা কো‌নো যুদ্ধ ছি‌লো না। সব কিছু একটা ষড়য‌ন্ত্রের ফসল। কিন্তু এই সময়‌কে একা‌ডে‌মিকভা‌বে তু‌লে ধরা হয়নি। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর প্রান্তরে, স্বল্প সময়ের একটি ছোট যুদ্ধের মাধ্যমে শুরু হয় পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম দীর্ঘ ও ভয়াবহ অর্থনৈতিক লুন্ঠনের এক অধ্যায়। শুধু বাংলার স্বাধীনতা নয়, হারিয়ে যায় এর অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, সাংস্কৃতিক আত্মমর্যাদা এবং রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ। পলাশীর যুদ্ধ ছিল আসলে একটি ষড়যন্ত্রমূলক অভ্যুত্থান, যার পেছনে ছিল ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি—বিশ্বাসঘাতক মীর জাফরদের মতো দেশীয় সহযোগীদের সঙ্গে নিয়ে। নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার মৃত্যুর পর ব্রিটিশরা নবাবের রাজধানী মুর্শিদাবাদে প্রবেশ করে রাজকোষ থেকে সরাসরি নিয়ে যায় প্রায় ২৫ কোটি টাকা (সেই সময়কার)। আধুনিক মূল্যমান অনুযায়ী এটি প্রায় ৪ বিলিয়ন পাউন্ডের বেশি। লর্ড ক্লাইভ নিজেই তখনকার ইংরেজি মুদ্রায় ২,৩৪,০০০ পাউন্ড ঘুষ নেন, যা আজকের প্রায় ৩৬ মিলিয়ন পাউন্ডের সমতুল। ব্রিটিশ সেনা ও অফিসাররা ব্যক্তিগতভাবে লাখ লাখ টাকা আত্মসাৎ করে। স্থানীয় কৃষকদের ওপর চাপানো হয় দ্বিগুণ কর। জমিদারদের মাধ্যমে এই কর আদায় করা হতো সহিংস উপায়ে। এতে কৃষক ও তাঁতিরা দারিদ্র্যে ধ্বংস হয়।”

দৈনিক আমার দেশ এর নির্বাহী সম্পাদক (আবাসিক) অলিউল্লাহ নোমান ব‌লেন, “আমরা এখ‌নো পরাধীনতার কবল থে‌কে বের হ‌য়ে আস‌তে পা‌রি‌নি। সেই পরাজয়ের রেশ এখনও আমাদের সমাজে বিদ্যমান—রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতিতে। আমাদের মসলিন, তাঁতশিল্প বা লোকশিল্প আজো যথার্থভাবে পুনরুজ্জীবিত হয়নি। আমরা বিদেশি পণ্যকে শ্রেষ্ঠ মনে করি—যেখানে আমাদের নিজের ঐতিহ্য ছিল বিশ্বসেরা। সবাই চেষ্টা করলে অখণ্ড বাংলাদেশ বাস্তবায়ন করা সম্ভব।”

ইন্জিনিয়ার মুগনি চৌধুরী ইসরায়লে ইরান যুদ্ধের উদাহরণ তুলে ধরে বাংলাদেশের এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম শক্তিশালী করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বাংলার আকাশ প্রতিরক্ষায় একক যোদ্ধা হিসেবে সর্বাধিক চারটি ইসরায়েলি বিমান ভূপাতিত করার রেকর্ডধারী শফিউল আজমের মত পাইলট তৈরী করার কথা বলেন।

মানবাধীকার কর্মী হাসনাত হাবীব বলেন,“ আজ ২৩ জুন, পলাশী ট্রাজেডির ২৬৮ বছর পূর্তি। ১৭৫৭ সালের এই দিনে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়েছিল। কিন্তু সেই হারানো স্বাধীনতার সূর্য আর উঁকি দেয়নি এই ভূখণ্ডের আকাশে। নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার পরাজয় কোনো সাধারণ সামরিক ব্যর্থতা ছিল না; এটি ছিল ষড়যন্ত্র, বিভাজন, দুর্নীতি, নেতৃত্বের অদূরদর্শিতা ও জনসচেতনতার অভাবের এক নিষ্ঠুর পরিণতি—যার ছায়া আজও আমাদের রাষ্ট্র ও রাজনীতিতে স্পষ্ট। পলাশীর শিক্ষা হলো—জাতীয় ঐক্য, দূরদর্শী নেতৃত্ব, সততা, আত্মনির্ভরতা ও জনসচেতনতা ছাড়া স্বাধীনতা টেকসই হয় না। আমরা যদি বারবার ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে ব্যর্থ হই, ভবিষ্যতেও স্বাধীনতা ঝুঁকির মুখে পড়বে। আজ ফিলিস্তিনের পক্ষে মানবিক অবস্থান নিতে আমরা সচেষ্ট, যা খুবই প্রশংসনীয়। কিন্তু আমাদের পাশেই আরাকান (রাখাইন) রাজ্যে যে বর্বরতা—গণহত্যা, ধর্ষণ, দমন-পীড়ন—তা নিয়ে আমরা নিরব। অথচ এই অঞ্চলটি ইতিহাসের প্রেক্ষিতে আমাদেরই অংশ, যা ১৭৮৫ সালে এই অঞ্চলটি আমাদের থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয় এবং ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকগণ কর্তৃক মিয়ানমারের অন্তর্ভুক্ত হয়। কাশ্মীর নিয়ে পাকিস্তান যেমন তার দাবিতে অনড়, তেমনি আমাদেরও উচিত আন্তর্জাতিক ফোরামে আরাকান নিয়ে আওয়াজ তোলা। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে গত ৫৩ বছরে কোনো সরকারই এটি করেনি। এখন সময় এসেছে ঐতিহাসিক অধিকার ও মানবিক দায়বদ্ধতা থেকে আরাকান ইস্যুতে জাতীয় অবস্থান স্পষ্ট করা। আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ের চেষ্টা চালাতে হবে—এটাই হবে আমাদের ইতিহাসের প্রতি সত্যিকারের শ্রদ্ধা ও ভবিষ্যতের প্রতি দায়িত্বশীলতা “

সাংবাদিক ও কমিউনিটি অ্যাক্টিভিস্ট বদরুজ্জামান বাবুল দেশে ও প্রবাসে বসবাসরত বুদ্ধিজীবীদের অখণ্ড বাংলাদেশ আন্দোলনের সাথে আরো বেশি সম্পৃক্ত হওয়ার আহ্বান জানান। 

সভাপতির বক্তব্যে কবি আহমেদ ময়েজ বলেন, “আমি সবার বক্তব্য খুব মনোযোগ দিয়ে শুনেছি এবং সবার বক্তব্য নোট করেছি। ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধ হয়েছে। এর মাঝে গঙ্গা-ভাগীরথী দিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে, ইতিহাস বিকৃত করার চেষ্টাও হয়েছে অনেক। ইংরেজ ও তাদের দোসররা মিলে দেশি-বিদেশি ফরমায়েশি লেখক ও তথাকথিত গবেষক দিয়ে ইতিহাস মুছে ফেলার কসরতও কম হয়নি। সিরাজ-উদ-দৌলার চরিত্রে কলঙ্ক লেপন করে কলকাতায় একটা মনুমেন্ট তৈরী করা হয়েছিলো। অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় ১৮৯৮ খ্রি. প্রকাশিত তাঁর “সিরাজ-উদ-দৌলা” গবেষণা গ্রন্থে যুক্তি-প্রমাণ দিয়ে মনুমেন্ট তৈরী শাসকগোষ্ঠীর মিথ্যা প্রচার বলে প্রমাণ করেন। পরবর্তীতে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু, কবি কাজী নজরুল ইসলাম এবং মাওলানা আকরাম খানের উদ্যোগে ১৯৩৬ খ্রি. ২৩শে জুন কলকাতায় প্রথম পলাশী দিবস পালন হয়। ১৯৪০ খ্রি. বাঙালি হিন্দু-মুসলিমের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের ফলে ইংরেজরা বাধ্য হয় ওই হলওয়ে মনুমেন্ট তুলে নিতে। আমি বর্ডার লাইনে একটা কথা বলবো বিশ্বাসঘাতকতাই ছিলো মূল বিষয়। নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার যেহেতু জনপ্রিয়তা ছিলো, লোকজন সিরাজকে ভালোবেসেছে, একারণে পলাশী যুদ্ধের পর সিরাজের চরিত্রে ইংরেজদের কালিমা লেপন করতে হয়েছে। মিথ্যা ইতিহাস, মিথ্যা বয়ান তৈরী করতে হয়েছে। ইংরেজদের এসব করতে দেখেই বুঝা যায় নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা কোন জনবিচ্ছিন্ন নবাব ছিলেন না। সিরাজ-উদ-দৌলার জনপ্রিয়তা না থাকলে, নবাবের ওপর জনগণের আস্থা না থাকলে  তাদেরকে এসব করতে হতো না। এসব না করলে তারা প্রায় দুইশো বছর শাসন করতে পারতো না। কিন্তু ইতিহাস কারো কৃতদাস হয় না। তাই দেরিতে হলেও সত্য ইতিহাস বেরিয়ে এসেছে। আমাদেরকে এখন নতুন করে ইতিহাস লিখতে হবে। ইংরেজদের লিখিত ইতিহাস, ইংরেজদের লিখিত বয়ানকে চ্যালেন্জ করতে হবে।”

কারিগরি ক্রুটির কারণে বাংলাদেশ থেকে দৈনিক যুগান্তর পত্রিকার সম্পাদক কবি আবদুল হাই শিকদার, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের অর্থ সমন্বয়ক দিদারুল ভূঁইয়া ও মনোবিজ্ঞানী নাজমুল হোসাইনকে এবং কানাডা থেকে ড. হাসান মাহমুদকে আলোচনা সভায় যুক্ত করতে না পারায় আয়োজকেরা দু:খ প্রকাশ করেন।

এসময় দর্পণ টিভির পরিচালক রহমত আলী, কবি কাইয়ুম আবদুল্লাহ, ড.মুহাম্মাদ মুঈনুদ্দীন মৃধা, সাংবাদিক শেখ মুহিতুর রহমান বাবলু, ইক্যুয়াল রাইটস ইন্টারন্যাশনালের প্রেসিডেন্ট সাংবাদিক মাহবুব আলী খানশূর, মানবাধীকার কর্মী ইউসুফ হোসাইনসহ কমিউনিটির গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন। 

আলোচনা সভা শেষে পলাশী থেকে আজ পর্যন্ত দেশের জন্য যারা জীবন দিয়েছেন, সেসব বীর শহীদদের রুহের মাগফিরাত কামনায় বিশেষ মোনাজাত করা হয়। আলোচনা সভায় ‘অখণ্ড বাংলাদেশ আন্দোলন’ এর একটি উপদেষ্টা পরিষদ গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

প্রেস বিজ্ঞপ্তি     


আরো পড়ুন!

Sidebar Banner
Sidebar Banner