২০১৫ সালে ছাত্রশিবির আমাকে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় শিফট করে। এখানে এসে আমি যার আশ্রয়ে থেকেছি তিনি হলেন পাবনার সিরাজ ভাই। তিনি বুয়েটের সাবেক শিবির সভাপতি ছিলেন। তিনি আমাকে ছোট ভাইয়ের মতো স্নেহ ও ভালোবাসা দিয়ে বরণ করেছিলেন। আমার কোনো বড় ভাই নেই। আমিও একজন বড় ভাই পেয়ে মহা খুশি। তিনি এমন একজন দায়িত্বশীল ছিলেন যার সাথে হাসি তামাশা করা যেত, বিতর্ক করা যেত। আমি একটু এগ্রেসিভ টাইপের মানুষ। বিতর্ক করার বেশিরভাগ সময়ই আমার কন্ঠ উঁচু হয়ে যেত। সিরাজ ভাই শান্ত, হাসিখুশি ও নরম মনের মানুষ ছিলেন। আমাদের ভুল হলেও কখনোই তিনি বকা ঝকা করতেন না।
আমি ঢাকায় এসে জানতে পারলাম ভাইয়ের মাস্টার্স এখনো শেষ হয়নি। তিনি বুয়েটে যেতে পারেন না। ভয় আছে, ছাত্রলীগ তাকে দেখতে পেলে মারবে। আমি ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম, এখন যারা ছাত্রলীগ করে তারা কি আপনাকে চেনে? তিনি বললেন সভাপতি সেক্রেটারি ছাড়া বাকীরা তেমন চেনার কথা না। পরের বছর সিরাজ ভাই মাস্টার্স শেষ করার উদ্যোগ নিলেন। বুয়েটের শিবির কর্মীদের মধ্যে দুই একজন পাহারা দিত ছাত্রলীগের কেউ আছে কিনা? সিরাজ ভাই ছাত্রলীগ এড়িয়ে পরীক্ষা শেষ করলেন।
এরপর রইলো থিসিস। পরের বছর থিসিস কমপ্লিট করার চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। উনি যখন বুয়েট ক্যাম্পাসে যেতেন তখন তার সাথে আমাদের মধ্য থেকে কেউ একজন যেতাম যারা বুয়েটের বাইরের মানুষ। বেশিরভাগ সময় আমিই যেতাম। আমি ডিপার্টমেন্টের সামনে বসে থাকতাম। বুয়েটের দুই একজন শিক্ষক ও কর্মকর্তার সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন ভাই। আমি ওনাদের সাথে সমন্বয় করে সিরাজ ভাইয়ের বিপদ হয় কিনা সেটা নজরে রাখতাম। এভাবে বহুদিন গিয়েছে।
ভাইয়ের থিসিসও শেষ পর্যায়ে চলে এসেছে। ভাইয়ের সাথে আমার যোগাযোগ কমে গিয়েছে। ২০১৫ সালে ভাই যে বিভাগে কাজ করতেন আমি সেই বিভাগেই দায়িত্ব পালন করছিলাম আর তিনি শিবিরের কেন্দ্রীয় অফিস সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। কিন্তু তারপরও আমি তাঁকে আমার অভিভাবক হিসেবে গণ্য করতাম, এখনো করি। আর তিনিও আমাকে ছোট ভাইয়ের স্নেহ দিতেন।
২০১৭ সালের শেষ দিকে তার ডিফেন্সের ডেট পড়ে। তিনি থিসিসে কিছু কারেকশনের জন্য বুয়েটে গিয়েছিলেন। তার মধ্যে একটা কনফিডেন্স চলে এসেছিল এখন আর তাকে কেউ চিনে না, সুতরাং অসুবিধা হবে না। তিনি আমাদের কাউকে জানান নি। এমনকি বুয়েট শিবিরকেও জানাননি। ভাইয়ের এই বিষয়টা আমি বুঝতাম। ওনার জন্য আমরা পাহারা দিচ্ছি এই বিষয়টাতে উনি অনেক লজ্জিত হতেন। ওনার জন্য আমরা কষ্ট করছি এই ভেবে উনি সংকুচিত থাকতেন।
বিপদ যেদিন এসেছে সেদিন ভাই কাউকেই কিছু বলেন নাই। নিজে নিজে বুয়েটে গিয়েছেন। ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা তাকে চিনে ফেলে। ধরে নিয়ে তাকে মারতে শুরু করে। আমরা জানতেই পারি নি ভাই বিপদে পড়েছেন। পরে যখন জানাজানি হয়েছে তখন চেষ্টা তদবির করে শিক্ষকদের পাঠিয়েও সিরাজ ভাইকে উদ্ধার করা যায় নি। এত অসহায় লাগছিল বলার মতো না। মনে কত যে আক্ষেপ হচ্ছিল, আল্লাহ কেন আমাদের এতো অসহায় করে এই দেশে পাঠালেন!!
অবশেষে পুলিশে খবর দিয়ে ভাইকে উদ্ধার করা গেল। ততক্ষণে পেরিয়ে গেছে চার ঘন্টা। ভাইকে পিটিয়ে দুই পা ও এক হাত ভেঙ্গে ফেলেছে। ওনার ফর্সা শরীর কালো হয়ে ফুলে ঢোল হয়ে গিয়েছিল। বেঁচে ছিল এটাই আমাদের ভাগ্য। অবশেষে শাহবাগ থানা তাকে এরেস্ট করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। কী ভয়ংকর রাষ্ট্র! একজন ছাত্রের কোনো ফৌজদারি অপরাধ নেই। তিনি এতো নরম মানুষ ছিলেন যে, আমাদেরকেও চোখ গরম করে অথবা কণ্ঠ উঁচু করে কথা বলতেন না। উল্টো আমরা মাঝে মধ্যে তার সাথে বিতর্ক করতে গিয়ে বেয়াদবি করতাম। তিনি কোনো নিষিদ্ধ সংগঠন করেন না। শিবির করার অপরাধে তার ক্যাম্পাসের ছোট ভাইরা তাকে এমনভাবে পিটিয়েছে যে তার মৃত্যু ঘনিয়ে এসেছে। শিক্ষকরা এর প্রতিবাদ করার সাহস পায়নি। পুলিশ এসে সন্ত্রাসীদের রিকোয়েস্ট করে নিয়ে গিয়ে ভিকটিমের বিরুদ্ধেই মামলা দিয়েছে। আহ!!
সিরাজ ভাইকে ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি করানো হলো। তিনি সেখানেই ছিলেন। আমি মাঝে মধ্যে সকাল বেলা গিয়ে ভাইয়ের সাথে কথা বলতাম। শীতের সকালে ভাইয়ের ঘুম নষ্ট করে হাসপাতালে বসে করে গল্প করেছি। আমার কাছে মনে হতো এই ঘুম নষ্টে ভাই বিরক্ত হতেন না। এরই মধ্যে আমি ছাত্রশিবির থেকে বিদায় কনফার্ম করেছি। বিয়েও ঠিক হয়েছে। সিরাজ ভাই অসুস্থ থাকায় ওনার থেকে বিয়েকেন্দ্রিক পরামর্শ নিতে পারিনি। আমি ঢাকা মেডিকেলে দুইবার গিয়েছি ভাইকে বিয়ের খবর জানাতে। কিন্তু বলতে না পেরে ফেরত এসেছি। দুইটা সংকোচ কাজ করেছে। এক. অবিবাহিত বড় ভাইয়ের কাছে ছোট ভাইয়ের বিয়ের খবর। দুই. ভাইয়ের এই কঠিন দুঃসময়ে আমি বিয়ের মতো বড় কাজ করছি। সকালে আমি দেখা করে বলতে ব্যর্থ হয়ে চলে এলাম। দুপুরে আমাকে তৎকালীন বুয়েট সভাপতি ফোন দিয়ে বললেন, কী রে ভাই? আপনি আমাদের সবাইকে বিয়ের নিউজ দিলেন, সিরাজ ভাইকে দিলেন না কেন? আমি তো মনে করেছি ভাই জানেন। আমি সেজন্য ভাইয়ের সাথে এই বিষয় নিয়ে আলোচনা করছিলাম। আমি বললাম, ভাইকে তো বলার জন্য গিয়েছিলাম। কিন্তু সংকোচের কারণে বলতে পারিনি।
সিরাজ ভাই বিদায়ের কথা জানতেন তবে বিয়ের কথা না জানায় কষ্ট পেয়েছিলেন। পরদিন সকালে গিয়ে লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে ভাইকে সবিস্তারে সব বললাম। ভাই দোয়া করে দিলেন। আমাদের বাসা তখন চট্টগ্রামে। আমি বিয়ের উদ্দেশ্যে বের হয়ে ভাইকে কল করলাম। কল রিসিভ করলো সিরাজ ভাইয়ের ছোটো ভাই। জানালেন তাকে আজ কোর্টে নিয়ে যাবে পুলিশ। সেজন্য প্রস্তুতি চলছে। ভাইয়ের সাথে কথা বলতে পারলাম না। কিছুক্ষণ পর সিরাজ ভাই কল করলেন। কোর্ট থেকে তাকে কারাগারে নিয়ে যাচ্ছে। আমি যাচ্ছি বিয়ে করতে আর আমার অভিভাবক যার দুই পা ভাঙা, এক হাত ভাঙা, নিজে নিজে খেতে পারে না, ওয়াশ রুমে যেতে পারে না এমন অসহায় অবস্থায় সিরাজ ভাই যাচ্ছেন কারাগারে। আমার এতো খারাপ লাগছিলো যে, আমি ভীষণ হতাশ হয়ে পড়েছি। বার বার চোখ ভিজে যাচ্ছিল।
আমার বিয়ের দিনটা ছিল আমার জন্য সবচেয়ে কঠিন একটা দিন। এত কঠিন দিন আমার জীবনে খুব কম এসেছিলো।
সংগৃহীত