ভ্রমন ২৯ জুলাই ২০২৪

শেক্সপিয়ারের জন্মস্থানে সাংবাদিকদের একদিন, সারাদিন— সারওয়ার-ই আলম

post

শেক্সপিয়ারের বাড়ির সামনে লন্ডন বাংলা প্রেস ক্লাবের সামার ট্রিপে অংশগ্রহণকারীদের একাংশ -ছবি tv19online.

এ ছিল এক বিরাট বহর! তিনটি বাসে বোঝাই হয়ে আমরা ব্রিটেনে কর্মরত বাংলাভাষী গণমাধ্যমকর্মীরা পরিবারের সদস্যদেরকে নিয়ে গতকাল রোববার গিয়েছিলাম শেক্সপিয়ারের জন্মস্থান স্ট্রাটফোর্ড আপন অ্যাভনে। অ্যাভন নদীর তীরে বেশ ছিমছাম দৃষ্টিনন্দন একটি শহর।হাসি-আনন্দে সুন্দর একটি দিন কাটল আমাদের। পথের দূরত্ব কমও নয়! লণ্ডন থেকে প্রায় সোয়াশ' মাইল। যাত্রা বিলম্ব আর যানজটের কারণে আসা যাওয়াতেই প্রায় আট ঘণ্টার 'জার্নি'। কিন্তু যাত্রাপথের ক্লান্তি আমাদেরকে স্পর্শ করতে পারেনি কারণ বাসে কবিতা, গান, ধাঁধা ও হাস্যরসাত্মক গল্পকথায় সময়টা ছিল দারুণ উপভোগ্য! 

এক নম্বর বাসে আমাদের বসার জায়গা নির্ধারিত ছিল। আমার সঙ্গে যথারীতি আমার তিন বাক্স পেটরা সানিয়া, সাহির ও সামির। ক্লাবের সম্মানিত প্রেসিডেণ্ট জোবায়ের ভাইসহ এ বাসে অন্যান্য সম্মানিত সহকর্মীদের মধ্যে ছিলেন আবু মুসা ভাই, নিলুফা আপা, উর্মি আপা, মিসবাহ ভাই, রহমত আলি ভাই, আনাস ভাই, কলি ভাবী, রিনা দি, গুঞ্জন, বাতিরুল ভাই, রুমি হক, তুলি, বাবলু ভাই, সাদেক ভাই, সাকলায়েন ভাই, হেলাল সাঈফ ভাই, শামসুল তালুকদার ভাই প্রমুখ। আর আমাদেরকে দেখাশোনার দায়িত্ব পালন করেন এফএম টিভির ফয়সল মাহমুদ। তিনি খুবই নিষ্ঠাবান সহকর্মী। সারাক্ষণ ব্যস্ত ছিলেন আমাদের ভ্রমণটিকে আনন্দপূর্ণ করার চেষ্টায়।

পৌনে এগারোটায় রওয়ানা হয়ে স্ট্রাটফোর্ড পৌঁছাতে পৌঁছাতে বেলা আড়াইটা। সেখানে আরো দুটি বাসে এসে যোগ দিলেন অন্যান্য সহকর্মীবৃন্দ ও তাদের পরিবারের সদস্যবৃন্দ। লণ্ডনের বাহিরের অনেক শহর থেকে সহকর্মীদের অনেকে এসেছেন নিজেরা ড্রাইভ করে। ঘাসে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আমরা একসঙ্গে দুপুরের খাবার খেলাম। বাসমতি চালের ভাতের সঙ্গে গরুর মাংস, মুরগির মাংস ও ডালটা মন্দ ছিল না। পুরো এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছিল বাঙালি খাবারের ঘ্রাণ। বাঙালিআনায় আমাদের পিকনিক চলাকালে ব্যাণ্ডস্টাণ্ডে চলছিল লাইভ মিউজিক। সুললিত কণ্ঠে ইংরেজ গায়িকা তখন গাইছিলেন ডলি প্যাট্রনের বিখ্যাত একটি গান, 'জোলিন জোলিন জোলিন আই অ্যাম বেগিং অব ইউ প্লিজ ডোন্ট টেক মাই ম্যান।' এ পর্যন্ত যত ইংরেজি গান শুনেছি অর্থবোধের দিক থেকে, সুরের দিক থেকে গত কয়েক দশক ধরে এটি আমার পছন্দের তালিকায় শীর্ষে। ফলে পিকনিকটা আরও আনন্দপূর্ণ হলো।

 দুপুরের খাবার শেষে সদস্যবৃন্দ ও তাদের পরিবারের সদস্যদের অংশগ্রহণে বিভিন্ন রকম খেলাধূলার আয়োজন করা হয়। এই আয়োজনে মহিলাদের হাঁড়িভাঙ্গা এবং ছেলেদের কাবাডি ছিল খুবই উপভোগ্য। না হাটে হাঁড়ি নয়, মাঠে হাঁড়ি ভেঙ্গেছেন আমাদের নারীরা। এবং সেটা বীরদর্পে। চোখ বাঁধা অবস্থায় হেঁটে এসে দূরে রাখা নিশানায় কীভাবে যে তাঁরা এত নিখুঁতভাবে হাতে ধরা লাঠি দিয়ে আঘাত হানছিলেন সেটা দেখে বিস্মিত না হয়ে উপায় ছিল না।

 সে যাই হোক হাঁড়িভাঙ্গা শেষ, কাবাডি শেষ, এরপর আমাদের যাত্রা শুরু পায়ে হেঁটে। গন্তব্য শেক্সপিয়ারের বাড়ী। পার্ক থেকে মিনিট দশেকের পথ। সুন্দর রৌদ্রোজ্জ্বল দিন। চারদিকে ঝলমলে রোদ। পথে পথে ফুল ফুটে আছে। বিলেতের গ্রীষ্ম বলে কথা। যেন চারদিক হাসছে!

 শেক্সপিয়ারের বাড়ি পৌঁছাতে পৌঁছাতে পাঁচটা বেজে গেল। চারদিকে অসংখ্য পর্যটকের ভীড়। ছোট্ট একটি বাড়ি। পাঁচশ' বছর আগে বিখ্যাত ইংরেজ কবি এই বাড়িতে জন্ম নিয়েছিলেন, তাঁর শৈশব কাটিয়েছিলেন, এসব পথে তাঁর স্মৃতি জড়িয়ে আছে ভাবতেই ভাল লাগছিল। বেশ কিছু সময় আমরা এই ঐতিহাসিক বাড়ির সামনে কাটিয়ে দেখতে গেলাম শেক্সপিয়ারের সমাধি। একটি চার্চের ভেতর তাঁর সমাধি। মাত্র বায়ান্ন বছর বয়সে বিশ্বসাহিত্যকে শেক্সপিয়ার যা দিয়ে গিয়েছেন গত সাড়ে চারশ' বছর ধরে বিশ্ব সাহিত্যকে তাঁর সৃষ্টি কীভাবে সমৃদ্ধ ও প্রভাবিত করছে সে কথাগুলোই আলোচনা করছিলাম সমাধির সামনে দাঁড়িয়ে আমি, জোবায়ের ভাই, তাইসির ভাই, তারেক ভাই, আকবর ভাই, বাসন ভাই, বাবলু ভাই ,শামসুল তালুকদার ভাই, আকরাম ভাই প্রমুখ। ছবি তুলে সমাধিস্থল কে স্মৃতিতে ধারণ করলাম আমরা।

সমাধি দেখা শেষ করে ফেরার পথে দেখা মিলল একটি থিয়েটারের। শেক্সপিয়ারের নাটক প্রদর্শিত হয় এখানে। ছবি তুলে স্মৃতিতে ধারণ করলাম সেটিও। ততক্ষণে প্রায় সন্ধ্যে সাতটা। সবার পা অচল হয়ে আসছিল সারাদিনের হাঁটাহাঁটির ক্লান্তিতে। বাসে পৌঁছে যে যার মত করে গা এলিয়ে বসে পড়লাম বাড়ি ফেরার জন্য। পথে যানজট। তাই নির্ধারিত সময় থেকে বেশ বিলম্বে পৌঁছলাম লণ্ডনে। নিউবুরি পার্ক যখন পৌঁছেছি তখন রাত পৌনে এগারোটা। ফিটবিটে দেখি বারো হাজার স্টেপ হেঁটেছি সারা দিনে। তার মানে আমাদের চার বছরের সামিরও। কিন্তু একটি ঐতিহাসিক স্থান দেখার আনন্দে আমরা সবাই এতটাই বিভোর ছিলাম যে কোনো ক্লান্তিই তখন আমাদের কাবু করতে পারেনি। আমাদেরকে সুন্দর একটি দিন উপহার দেয়ার জন্য এলবিপিসি'র ইভেন্ট সেক্রেটারি রূপি আমিন আপাসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে অশেষ ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাতেই হয়। শুধুমাত্র ক্লাবের সদস্যদের সৌহার্দ বাড়ানোর জন্যই নয়, পরিবারের সদস্যদের একে অপরের সঙ্গে পরিচয় ও আন্তিরকতা বাড়ানোর জন্যও এ ধরণের আয়োজনের যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে।

 ফেরার পথে একটি মধুর স্মৃতি তৈরি হলো। আমাদের সঙ্গে বারো হাজার স্টেপ হেঁটে হেঁটে সামিরের ছোট ছোট পা দুটো ব্যথায় একেবারে কাহিল হয়ে গিয়েছিল। বাসে ও আমাকে বলে, বাবা আমি আর হাঁটতে পারব না, আমার পাগুলো খুব ব্যথা করছে।

বাস ড্রাইভার আমাদেরকে গ্যান্টস হিল নামিয়ে দিলেন। সানিয়া, সাহির ও আমার জন্য গ্যান্টস হিল থেকে নিউবুরি পার্ক হেঁটে আসাটা কোনো সমস্যা নয়। কিন্তু সমস্যা হলো সামিরকে নিয়ে। ও পায়ে ব্যথা নিয়ে আর হাঁটতে পারবে বলে মনে হলো না। আমাদের সঙ্গে তখন সহকর্মী আই অন টিভির রিনা দি ও তাঁর পিএইচডি অধ্যয়নরতা কন্যা গুঞ্জন। তাঁদেরকে নেয়ার জন্য রিনা দি'র পতি এসেছেন গাড়ী নিয়ে। সামিরের পায়ে ব্যথার কথা শুনে গুঞ্জন বলল, আংকেল সামিরের যেহেতু পায়ে ব্যথা করছে তুমি ওকে নিয়ে আমার বাবার সঙ্গে গাড়িতে চলে যাও, আমি হেঁটে বাসায় চলে যাব।

রাত তখন পৌনে এগারোটা। এত রাতে হেঁটে বাসায় যাওয়াটা মেয়েটির জন্য মোটেই নিরাপদ ছিল না। তাছাড়া দূরত্বও একেবারে কম নয়। কিন্তু ছোট্ট সামিরের জন্য গুঞ্জন যে কষ্ট স্বীকার করল তা সানিয়া, সাহির ও আমাকে খুব স্পর্শ করে গেছে। আমরা খুব অভিভূত হয়েছি সামিরের প্রতি ওর ভালবাসা দেখে। বাসায় পৌঁছে সানিয়া ও সাহির গুঞ্জনের কথা খুব বলছিল। ওর প্রশংসা করছিল। প্রেস ক্লাব কীভাবে একটি বৃহৎ পরিবার হয়ে ওঠেছে এই ছোট্ট ঘটনাটি তার এক চমৎকার উদাহরণ। আমাদের আনন্দ-ভ্রমণটি শেষ হলো এই মধুর অভিজ্ঞতা দিয়ে। ( অসম্পূর্ণ ও অসম্পাদিত ) 

আরো পড়ুন!

Sidebar Banner
Sidebar Banner