নিউজ ডেস্ক,টিভি নাইনটিন অনলাইন
টাঙ্গাইল: হাত,পা একেবারেই চিকন। মুখ বাঁকা, স্পষ্ট কথা বলতে পারেন না। কিছুটা শ্রবণ শক্তিহীন। সামির জন্ম ২০০৬ সালে। দাঁড়ানোর সক্ষমতা না থাকায় হাতের ওপর ভর করে বসে বসে এগিয়ে চলা সামি অনলাইন সার্ভে কাজ করে ৩ মাসে ৮০ হাজার টাকার উপরে আয় করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিযেছেন। সামির বাবা মীর সাজ্জাদ হোসেন পেশায় গাড়ি চালক। শারীরিক অসুস্থতার কারণে বর্তমানে তিনিও তেমন একটা কাজকর্ম করতে পারেন না। মা কাকলী পারভীন বেগম প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা। সমাজে প্রতিবন্ধী সন্তান জন্ম নেওয়া মানেই পরিবারের বোঝা এ প্রচলিত ধারণাকে পাল্টে দিয়েছেন টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলার আশরাফুল আলম সামি (১৮)। মেধাবী সামি বর্তমানে গোপালপুর সরকারি কলেজের এইচএসসি দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। তার বাড়ি উপজেলার কাজিবাড়ী গ্রামে। ওই গ্রামের মীর সাজ্জাদ হোসেন ও কাকলী পারভীন বেগম দম্পতির প্রথম সন্তান।পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, পিএসসি, জেএসসি ও এসএসসিতে সামি পেয়েছে জিপিএ-৫। এ পযন্ত তিনটি ট্যালেন্টপুলসহ মোট সাতটি বৃত্তি পেয়েছেন। রান্না-বান্না, ছোট সাইকেল চালানো, ক্রিকেট ব্যাটিং, কেরাম, কম্পিউটার চালানো ও গাছে ওঠায় পারদর্শিতা আছে সামির। এছাড়াও অনলাইনে সার্ভে কাজ করে ৩ মাসে ৮০ হাজার টাকার উপরে আয় করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন সামি। সামি স্পষ্ট কথা বলতে না পারায় বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। পরে তিনি খাতায় লিখে জানায়, আমি আমেরিকান ওয়েবসাইট ফ্রিক্যাশ, সার্ভেজুনকিসহ অন্যান্য সাইটে সার্ভের কাজ করি। এ অনলাইনের আয়ের টাকা দিয়ে একটি ল্যাপটপ, দুটি স্মার্টফোন ও বাসার আইপিএস কিনেছি। স্নাতকোত্তর শেষ করে ভবিষ্যতে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হতে চাই।সামির বাবা মীর সাজ্জাদ হোসেন বলেন, আমার ছেলে একজন প্রতিবন্ধী। আমার ছেলেকে যদি সরকারি ভাবে সহযোগিতা করা হয় তাহলে সে আরও এগিয়ে যেতে পারবে। সামি কম্পিউটার চালাতে পারে তাকে একটা চাকরির ব্যবস্থা যেন করে দেয় এটাই সরকারের কাছে আমার আকুল আবেদন।
সামির মা কাকলী পারভীন বেগম বলেন, আমার ছেলে প্রতিবন্ধী। প্রথমে মানুষ নানা কথা বলতো। প্রতিবন্ধী ছেলেকে পড়াশোনা করিয়ে কি হবে? আমি কারও কথায় থেমে যায়নি। নিজের সাধ্যমত ছেলের পড়াশোনা চালিয়ে গিয়েছি। শারীরিক প্রতিবন্ধকতা থাকলেও ছেলেকে নিয়ে ছোট বেলা থেকেই স্বপ্ন ছিল। তাই কোলে করে নিয়ে স্কুলে দিয়ে আসতাম। আবার যখন ছুটি হতো স্কুল থেকে নিয়ে আসতাম। প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ে নয়, শুরু থেকেই সাধারণ বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করিয়েছি। ছোট থেকেই ছেলের মেধা স্কুলের সহপাঠী ও শিক্ষকদের মুগ্ধ করত। আমার ছেলেকে নিয়ে এখন সবাই গর্ব করে। প্রতিবন্ধীরা সমাজের বোঝা নয়। তারাও কিছু করতে পারে সেটা আমার ছেলে দেখিয়ে দিয়েছে। সে গত ৩ মাসে ৮০ হাজার টাকার উপরে আয় করেছে। তিনি আরও বলেন, ছেলেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করাতে চাই। সরকার যদি সামির প্রতি নজর দেয় আইসিটি ডিপার্টমেন্ট বা কম্পিউটার অপারেটর পদে চাকরি ব্যবস্থা করে দেয়। তবেই আমার কষ্ট সার্থক হবে। এটাই সরকারের কাছে আমার চাওয়া।সামির সহপাঠীরা জানায়, শারীরিক প্রতিবন্ধকতা থাকলেও সামি অনেক মেধাবী ছাত্র। হাতের লেখাও সুন্দর। পড়ালেখায় আমরা সামির বিভিন্ন সহযোগিতা পাই। সামি যে প্রতিবন্ধী কেউ কোন খারাপ মন্তব্য করে না। সহপাঠীরা সবাই সামিকে ভালো চোখেই দেখে, সহযোগিতাও করে। সহপাঠী কামরুল ইসলাম বলেন, আমরা পড়াশোনায় নাম্বার কম পেলেও সামি অনেক ভালো নাম্বার পায়। আমাদের থেকে ফলাফলও ভালো করে। সে অনেক ভালো ছাত্র। সরকার যদি সামির একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দেয়। তাহলে সামি পরিবার ও সমাজের বোঝা হয়ে থাকবে না।গোপালপুর সূতী ভি এম সরকারি পাইলট মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আতিকুর রহমান জানান, সামিকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি। তার মা কোলে করে নিয়ে বিদ্যালয়ে আসতো। পরবর্তীতে একাই সাইকেল চালিয়ে আসত। শারীরিক প্রতিবন্ধকতা থাকলেও সামির মেধা আমাদের মুগ্ধ করত। আমাদের বিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন আমরা খুব বেশি খরচ সামির কাছ থেকে নিতাম না। আমার বিদ্যালয় থেকে পরীক্ষা দিয়ে জেএসসি ও এসএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়েছে। দোয়া করি সামি যেন ওর বাবা-মা ও সমাজের মুখ উজ্জ্বল করতে পারে। সবাই যেন বলতে পারে প্রতিবন্ধীরাও কিছু করতে পারে। তারা সমাজের বোঝা নয়। সামির মেধা অনুযায়ী ভালো কোনো চাকরি পেলে আমি অনেক খুশি হব।গোপালপুর সরকারি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মানিকুজ্জামান বলেন, সামি আমার কলেজের এইচএসসি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। ওর শারীরিক প্রতিবন্ধকতা থাকলেও অনেক মেধাবী ছাত্র। সামি ভবিষ্যতে আরো ভালো কিছু করতে পারবে।এ বিষয়ে গোপালপুর উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা এখলাছ মিয়া বলেন, ভবিষ্যতে যদি সামিদের জন্য নতুন কোন সুযোগ সুবিধা থাকে তাহলে আমাদের মন্ত্রণালয় থেকে তাকে অবশ্যই সার্বিক সহযোগিতা কবরো।