নিউজ ডেস্ক
টিভি নাইনটিন অনলাইন
ঢাকাঃ শীর্ষ গণমাধ্যম ভয়েস অব আমেরিকা (ভিওএ) বাংলার এক জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ মনে করছেন, অন্তর্বর্তী সরকার দেশের ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের চেয়ে বেশি নিরাপত্তা দিতে পারছে। তবে জরিপের ফলাফলে নিরাপত্তা নিয়ে ধারণায় মুসলিম ও অমুসলিমদের মধ্যে কিছুটা পার্থক্য লক্ষ্য করা গেছে।গত অক্টোবর মাসের শেষের দিকে পরিচালিত এই জরিপে দেখা গেছে, ৬৪ দশমিক ১ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করেন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের তুলনায় অন্তর্বর্তী সরকার ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে বেশি নিরাপত্তা দিচ্ছে।মাত্র ১৫ দশমিক ৩ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করেন, বর্তমান সরকার সংখ্যালঘুদের জন্য আগের চেয়ে খারাপ নিরাপত্তা দিচ্ছে। ১৭ দশমিক ৯ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করেন, পরিস্থিতি আগের মতোই আছে।জরিপে এক হাজার উত্তরদাতাকে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের আমলের সঙ্গে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনের তুলনা করতে বলা হয়।বাংলাদেশের জনতত্ত্বের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে জরিপের জন্য এক হাজার উত্তরদাতা বাছাই করা হয়। উত্তরদাতাদের মধ্যে সমানসংখ্যার নারী ও পুরুষ ছিলেন, যাঁদের মধ্যে ৯২ দশমিক ৭ শতাংশ মুসলিম।উত্তরদাতাদের মধ্যে অর্ধেকের একটু বেশির বয়স ৩৪ বছর বয়সের নিচে। উত্তরদাতাদের প্রায় এক-চতুর্থাংশ শহুরে মানুষ।বাংলাদেশে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে যে প্রতিশোধপ্রবণতা দেখা যায়, তার বড় এক ধাক্কা গিয়ে পড়ে দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘু, বিশেষ করে সনাতন ধর্মাবলম্বী বা হিন্দুদের ওপর।দেশের বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও ধর্মীয় স্থাপনাগুলোতে ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে।বাংলাদেশের মানবাধিকারকর্মী নূর খান বলেন, ‘আমরা দেখেছি, সংখ্যালঘুদের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার কারণে তাদের ওপর আক্রমণ হয়েছে। আবার শুধু সংখ্যালঘু হওয়ার কারণেও তাদের ওপর আক্রমণ হয়েছে। পঞ্চগড়ে আহমদিয়াদের আবাসস্থলে আক্রমণ হয়েছে, অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে।বাংলাদেশে সংখ্যালঘুরা যে বরাবরই ঝুঁকির মধ্যে থাকে, সেদিকে ইঙ্গিত করেন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের দক্ষিণ এশিয়ার পরিচালক মীনাক্ষী গাঙ্গুলি। তিনি বলেন, কোনো সরকার তাদের (সংখ্যালঘু) অধিকার রক্ষার জন্য খুব একটা কিছু করে না।তবে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পর প্রশাসন, বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও সাধারণ মানুষ এগিয়ে আসেন সংখ্যালঘুদের উপাসনাস্থল পাহারা দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য।সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত গুম কমিশনের একজন সদস্য নূর খান। ভয়েস অব আমেরিকাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘বেশ কিছু দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ আমরা লক্ষ করেছি, সাধারণ মানুষের তরফ থেকে, রাজনৈতিক দলের তরফ থেকে এবং ধর্মীয় গোষ্ঠীর তরফ থেকে। এর ফলে দেখা গেছে, পরবর্তী এক মাসের মধ্যেই অবস্থার উন্নতি হয়েছে।’
ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে পার্থক্য
ভয়েস অব আমেরিকার জরিপের ফলাফলে নিরাপত্তা নিয়ে ধারণায় মুসলিম ও অমুসলিমদের মধ্যে কিছুটা তফাত লক্ষ করা গেছে।মুসলিম উত্তরদাতাদের মধ্যে মাত্র ১৩ দশমিক ৯ শতাংশ মনে করেন, বর্তমান পরিস্থিতি আগের থেকে খারাপ।কিন্তু ধর্মীয় সংখ্যালঘু উত্তরদাতাদের ৩৩ দশমিক ৯ শতাংশ মনে করেন, তাঁদের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকার বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের চেয়ে খারাপ করছে।ঢাকার বাসিন্দা জয়তী সরকার আগে কখনো তাঁর বা পরিবারের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত ছিলেন না। কিন্তু এখন তিনি নিশ্চিত নন।
সংখ্যালঘুদের স্বস্তির জায়গা
জরিপে দেখা গেছে, মুসলিম উত্তরদাতাদের মধ্যে ৬৬ দশমিক ১ শতাংশ মনে করছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের চেয়ে অন্তর্বর্তী সরকার সংখ্যালঘুদের বেশি নিরাপত্তা দিচ্ছে।অন্যদিকে ধর্মীয় সংখ্যালঘু উত্তরদাতাদের মধ্যে ৩৯ দশমিক ৫ শতাংশ এই ধারণার সঙ্গে একমত।অর্থাৎ, সংখ্যালঘুদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ মনে করে, আগের তুলনায় তারা বেশি নিরাপত্তা পাচ্ছে।জয়তী সরকার নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কায় থাকলেও তিনি একটি স্বস্তির জায়গা দেখতে পাচ্ছেন। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ ১৫ বছর ধরে ক্ষমতায় ছিল। তাদের নেতা-কর্মীদের ছত্রচ্ছায়ায় লোকজন হিন্দুদের জমি অল্প দামে কিনেছে বা তাদের বিক্রি করতে বাধ্য করেছে। এরা এখন আর নেই। তাই একটা স্বস্তি বিরাজ করছে।ঢাকার বাসিন্দা ও একটি বেসরকারি সংস্থার কর্মকর্তা হীরেন পণ্ডিত মনে করছেন, সম্প্রতি গ্রামগঞ্জে সেনাবাহিনী মোতায়েনের ফলে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা পরিস্থিতি আগস্ট-সেপ্টেম্বরের চেয়ে ভালো হয়েছে। তবে তিনিও শঙ্কার মধ্যেই আছেন।হীরেন পণ্ডিত বলেন, ‘আমাদের গ্রামের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং এখনো আমরা নিরাপত্তা নিয়ে আশঙ্কার মধ্যে থাকি। একটা নিরাপত্তাহীনতা তো আছেই।’
আন্তর্জাতিক উদ্বেগ
বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তনের পর সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের মাত্রা হঠাৎ বেড়ে যাওয়ায় আন্তর্জাতিক পর্যায়েও উদ্বেগের সৃষ্টি হয়।ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র নিয়মিত তাঁর সরকারের উদ্বেগের কথা সংবাদমাধ্যমকে জানান।যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন গত ২৬ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।পরে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার জানান, দুই নেতা অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যসহ বাংলাদেশের সবার জন্য মানবাধিকার সুরক্ষার গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করেছেন।যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচনের আগে গত ৩১ অক্টোবর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক পোস্টে লেখেন, ‘আমি হিন্দু, খ্রিষ্টান ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে বর্বর সহিংসতার তীব্র নিন্দা জানাই, যারা বাংলাদেশে মব দ্বারা আক্রমণ ও লুটপাটের শিকার হচ্ছে, দেশটি সম্পূর্ণ বিশৃঙ্খলার মধ্যে রয়েছে।তবে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণকে ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ বলে অভিহিত করেছে। তারা বলেছে, হিন্দুদের ওপর নির্যাতনের খবর ‘অতিরঞ্জিত’ করে প্রচার করা হচ্ছে।অন্তর্বর্তী সরকারের ১০০ দিন পূর্তি উপলক্ষে গত ১৭ অক্টোবর জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন ড. ইউনূস। ভাষণে তিনি বলেন, কয়েকটি ক্ষেত্রে সংখ্যালঘুরা সহিংসতার শিকার হয়, কিন্তু সেগুলো ছিল রাজনৈতিক। অল্প যেসব সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে, তার মূল কারণ ছিল রাজনৈতিক। কিন্তু এসব ঘটনাকে ধর্মীয় আবরণ দিয়ে বাংলাদেশকে নতুন করে অস্থিতিশীল করে তোলার চেষ্টা হয়েছে।হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মীনাক্ষী গাঙ্গুলি বলছেন, শেখ হাসিনার ‘নিপীড়নমূলক’ শাসনের প্রতি ভারতের সমর্থনও হিন্দুদের ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে এবং ভবিষ্যতে নয়াদিল্লির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত, সব জায়গাতেই সংখ্যালঘুদের অধিকার নিয়ে চিন্তিত হওয়া। কিন্তু যেসব গোষ্ঠী ভুয়া তথ্য ছড়িয়ে ঘৃণা ও সহিংসতা ছড়াতে চায়, তাদের ব্যাপারে বিশেষ করে ভারতের আরও সাবধান হওয়া উচিত।
রয়েছে আস্থার সংকট
বাংলাদেশে যেকোনো অজুহাতে হিন্দুদের নিশানা করার ঘটনা নতুন নয়। মানবাধিকারকর্মী নূর খান যেমন বলছেন, দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতার সময় দুর্বলের প্রতি সবলের আঘাত তাঁরা বিগত দিনে দেখেছেন এবং এর প্রধান শিকার হয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়।তবে সাম্প্রতিক সময়ে ইতিবাচক ইঙ্গিত দেখতে পাচ্ছেন নূর খান। তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকারের সময় যে শঙ্কা ছিল, সে শঙ্কা ক্রমান্বয়ে কেটে উঠছে। একধরনের স্বস্তি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে আসতে শুরু হয়েছে। কিন্তু এখনই বলা যাবে না, তারা সম্পূর্ণ আস্থাশীল হতে পেরেছে কি না।’নিরাপত্তা নিয়ে কতটুকু আস্থাশীল হতে পারবেন, তা নিয়ে এখনো উদ্বিগ্ন জয়তী সরকার।নূর খানের মতে, একটা আশঙ্কা অনেক মানুষের মধ্যেই আছে যে আগামী তিন মাস পর চিত্র কী হবে। অর্থাৎ, আস্থার সংকট রয়েছে।নূর খান বলেন, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের আস্থার জায়গাটা আরও মজবুত হবে কি না, তা নির্ভর করবে আগামী ৬ থেকে ৯ মাসের কার্যক্রমের ওপর, সরকারের পদক্ষেপের ওপর।মানবাধিকারকর্মীরা মনে করছেন, সংখ্যালঘুদের তাঁদের অধিকার ও নিরাপত্তা সম্পর্কে জনসমক্ষে আশ্বস্ত করতে সরকার ও ছাত্রনেতাদের আরও পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।