বাংলাদেশ ১৫ আগস্ট ২০২৪

বঙ্গবন্ধু, এবারের পনেরই আগস্ট এবং প্রাসঙ্গিক কিছু কথা— সারওয়ার ই আলম

post

প্রচণ্ড অস্থির সময়ের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু দিবস পালিত হচ্ছে এ বছর। দিবসটি পালন নিয়ে বেশ কিছু অস্বস্তিও লক্ষ করা যাচ্ছে। মানুষ আর আবেগের আগের জায়গাটিতে নেই বলেই মনে হচ্ছে। যে মানুষটি বাংলার মানুষের মনের মণিকোঠায় ছিলেন সতত সশ্রদ্ধ ভালবাসায়, তাঁকে সেখান থেকে টেনে হেঁচড়ে বের করে নিজেদের একচ্ছত্র অধিকারে নিয়ে নিয়েছে আওয়ামী লীগ। যে বঙ্গবন্ধু ছিলেন সমগ্র জাতির, সে বঙ্গবন্ধুকে কেবলই আওয়ামী লীগের সম্পত্তিতে পরিণত করেছেন তাঁর কন্যা। গত বিশ বছরে বঙ্গবন্ধুকে উচ্চে তুলে ধরতে গিয়ে শেখ হাসিনার সরকার হাজারো কর্মসূচীর নামে জনগণের শত শত কোটি টাকা খরচ করেছেন। দেশে বিদেশে মুজিব শতবর্ষ উদযাপনের নামে কী তামাশাটাই না দেখেছি আমরা। গরীব দেশের মানুষের অর্থের কী অপচয়! অথচ এসবের একেবারেই কোনও দরকার ছিল না। কারণ বঙ্গবন্ধু ছিলেন বঞ্চিত মানুষের নেতা, দলমত নির্বিশেষে এদেশের আপামর জনগোষ্ঠীর গভীর ভালবাসার ধন— অনেক গৌরব ও গর্বের নাম। সে মহান মানুষটিকে একেবারে পচিয়ে ছাড়লেন তাঁর কন্যা।


কত নীচেই না নেমেছেন তিনি পিতাকে অনর্থক উচ্চে তুলে ধরার জন্য, মানুষের মনে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য। ক্ষমতার বাহাদুরি দেখিয়ে জোর করে কত কিছুই না চাপিয়ে দিয়েছেন জনগণের ওপরে। সেও আবার শ্রমজীবী জনগণের করের টাকায়! অফিস আদালতে বঙ্গবন্ধু। সরকারি ওয়েবসাইট খুললেই বঙ্গবন্ধু। টেলিভেশনে বঙ্গবন্ধু। টাকায় বঙ্গবন্ধু। দলিল-দস্তাবেজে বঙ্গবন্ধু। স্কুল-কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধু। সারাদিশে শুধু বঙ্গবন্ধু আর বঙ্গবন্ধু। শুধু দেশের নামটা বাংলাদেশ থেকে বদল করে বঙ্গবন্ধু দেশ করা বাকী ছিল! তাঁর এসব ক্রিয়াকলাপ দেখে মনে হতো এদেশটা স্বাধীন করতে আর কারও কোনও অবদান নেই, বঙ্গবন্ধু একাই দেশটাকে স্বাধীন করে দিয়ে গেছেন। এসব করে শেখ হাসিনা জাতিকে বঙ্গবন্ধুর ব্যাপারে একেবারে বিষিয়ে দিয়েছেন।

 ঢাকায় শাহবাগের মোড়ে আমাদের একটা হাসপাতাল ছিল। যুগ যুগ ধরে মানুষ পিজি নামে চিনতো। শেখ হাসিনার কী মনে আসলো তিনি এটাকে বিশ্ববিদ্যালয় বানিয়ে নাম দিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।

ফরিদপুরে মেডিকেল কলেজ করলেন সেটিরও নাম দিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ। সুনামগঞ্জেও বঙ্গবন্ধু মেডিকেল কলেজ। গাজীপুরে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম দিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। গোপালগঞ্জে একটা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় করলেন সেটাও বঙ্গবন্ধুর নাম থেকে বাদ গেল না। নাম দিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। আচ্ছা গোপালগঞ্জ না হয় ওনার জন্মভূমি। পিরোজপুরে কী হয়েছে? সেখানকার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নামও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। কিশোরগঞ্জে একই অবস্থা- বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়,কিশোরগঞ্জ।


 একটা মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয় করলেন হাসিনা সরকার সেখানেও অন্য কোনও জাতীয় নেতার নাম মাথায় আসলো না তাঁর। তিনি নাম দিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয়। লালমনিরহাটে একটা এভিয়েশন ও এরোস্পেস বিশ্ববিদ্যালয় করলেন সেটারও নাম দিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান এভিয়েশন ও এরোস্পেস বিশ্ববিদ্যালয়। গাজীপুরে ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয় সেটিরও নাম নির্বাচন করা হলো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয়,গাজীপুর।

 এ চিত্র সারাদেশে। যেমন: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, নারায়নগঞ্জ (প্রস্তাবিত) , বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান নভোথিয়েটার, ঢাকা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান নভোথিয়েটার, রাজশাহী (নির্মানাধীন), বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর নভোথিয়েটার, খুলনা (অনুমোদিত), বঙ্গবন্ধু নভোথিয়েটার, রংপুর ( প্রস্তাবিত), বঙ্গবন্ধু নভোথিয়েটার, বরিশাল (প্রস্তাবিত), বঙ্গবন্ধু নভোথিয়েটার, সিলেট (প্রস্তাবিত)।


 প্রথমে বিশ্ববিদ্যালয়, পরে নভো থিয়েটার। এরপর বঙ্গবন্ধুকে নামালেন সাফারি পার্কে। গাজীপুরে করলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক, গাজিপুর, ডুলহাজরায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক, ডুলহাজরা। বাদ পড়লো না জাদুঘরও। ঢাকায় করলেন বঙ্গবন্ধু সামরিক জাদুঘর। 

শুধু কী তাই! টাঙ্গাইলে একটা সেনানিবাস করলেন তার নামকরণ করলেন বঙ্গবন্ধু সেনানিবাস, অথচ এখানে জাতীয় নেতা মাওলানা ভাসানির সমাধিস্থল। কেন ক্যান্টনমেন্টটি কি তিনি মাওলানা ভাসানির নামে করতে পারতেন না?

 সেনানিবাস থেকে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গেলেন সেতুতে। বানালেন বঙ্গবন্ধু সেতু। এরপর স্টেডিয়াম। নাম দিলেন বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম। একটা আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র নির্মিত হলো তার নামও দিতে হলো বঙ্গবন্ধুর নামে। করলেন বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র,ঢাকা। গাজীপুরে হাইটেক পার্ক সেটাও বঙ্গবন্ধু হাইটেক সিটি,গাজীপুর। কুর্মিটোলার এরোন্যাটিক্যাল সেন্টারটিও বাদ পড়ল না বঙ্গবন্ধু নাম থেকে। শেষ পর্যন্ত খুলনায় ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট করলেন সেটিরও নাম দিলেন বঙ্গবন্ধু ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট, খুলনা।


 এরপর ছুটলেন উপগ্রহ, স্কয়ার, উদ্যানের দিকে। একে একে নাম দিলেন বঙ্গবন্ধু উপগ্রহ , বঙ্গবন্ধু স্কয়ার, ফরিদপুর, বঙ্গবন্ধু উদ্যান, বরিশাল, বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ-চীন প্রদর্শনী কেন্দ্র, পূর্বাচল। এরপর জাতির পিতাকে তুললেন টাওয়ারে। ঢাকায় করলেন বঙ্গবন্ধু টাওয়ার, ঢাকা।


 বিশ্ববিদ্যালয়, ক্যান্টনমেন্ট, উপগ্রহ, সেতু ও টাওয়ার করার পর কেউ একজন হয়তো বুদ্ধি দিয়েছে আপা কলেজ তো বাদ পড়ে যাচ্ছে। ব্যস শুরু হলো কলেজের নামকরণে বঙ্গবন্ধু। একে একে করলেন বঙ্গবন্ধু টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, টাঙ্গাইল, জতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সরকারি কলেজ, ঢাকা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু কলেজ, গাজীপুর, ফরিদগঞ্জ বঙ্গবন্ধু সরকারি কলেজ, ফরিদগঞ্জ , বঙ্গবন্ধু কলেজ, কুমিল্লা, বঙ্গবন্ধু কলেজ, খুলনা, বঙ্গবন্ধু কলেজ, ঢাকা, বঙ্গবন্ধু মহিলা কলেজ, কলারোয়া, বঙ্গবন্ধু ডিগ্রী কলেজ, রাজশাহী, শিমুলবাড়ী বঙ্গবন্ধু ডিগ্রি কলেজ, নীলফামারী, সরকারি বঙ্গবন্ধু কলেজ, গোপালগঞ্জ, সরকারি বঙ্গবন্ধু কলেজ, জামালপুর, বঙ্গবন্ধু ল কলেজ, মাদারীপুর এবং সরকারি শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, টুঙ্গিপাড়া। টাঙ্গাইল থেকে শুরু করে ক্ষান্ত দিলেন টুঙ্গিপাড়ায় গিয়ে।


 আমাদের একটি উপগ্রহ হলো সেটিও করা হলো বঙ্গবন্ধুর নামে। নৌবাহিনী একটা ক্ষেপণাস্ত্র কেন্দ্র করল তারও নাম দেওয়া হলো বানৌজা বঙ্গবন্ধু ফ্রিগেট নামে।

 এরপর শুরু হলো ভাস্কর্য নির্মাণ। দেশের আনাচে কানাচে অসংখ্য ভাস্কর্য নির্মাণ করা হলো বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে। অথচ এসবের কোনও দরকারই ছিল না। এসব ছিল তাঁর কন্যার সীমাহীন বাড়াবাড়ি। কারণ ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে এদেশটি স্বাধীন হয়েছে। কই তাঁদের কার নামে কী করেছেন শেখ হাসিনা? কী করেছেন জাতীয় চার নেতার নামে? কী করেছেন বীর শ্রেষ্ঠদের নামে? কী করেছেন ভাষা শহীদদের নামে? কী করেছেন বীরাঙ্গনাদের নামে। তাঁর সকল ধ্যানজ্ঞান ছিল শুধুই তাঁর পিতা, পিতা এবং পিতা। বঙ্গবন্ধুর প্রতি গভীর ভালবাসা থাকলেও দেশের জনগণ এটা মোটেই পছন্দ করেনি। জনগণ এটাকে নিয়েছে চরম বাড়াবাড়ি হিসেবে। মানুষ ভেতরে ভেতরে মারাত্মকভাবে বিষিয়ে উঠছিল তাঁর এসব কর্মকাণ্ডে। কিন্তু ভয়ে প্রতিবাদ করার সাহস পাচ্ছিল না। আর সে প্রতিবাদ নিকৃষ্ট রূপে প্রকাশ পেল গণঅভ্যুত্থানে হাসিনা সরকারের পতনের পর বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙ্গার মধ্য দিয়ে, তাঁর স্মৃতিময় বাড়িটিতে অগ্নিসংযোগের মধ্য দিয়ে। আমরা দেখলাম আর্মিও বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙ্গছে। এরকম জঘন্য ঘটনা বাংলার মাটিতে ঘটবে বাঙালি কল্পনাও করেনি। অথচ ঘটেছে তাই। আর এর একমাত্র কারণ তাঁর কন্যা। তাঁর কন্যার সীমাহীন বাড়াবাড়ি। সীমাহীন পাপ। পিতাকে দিতে হলো কন্যার পাপের প্রায়শ্চিত্ত! ঘটনাটি খুব তাৎপর্যপূর্ণ। ভবিষ্যতের শাসকদের জন্য, রাজনৈতিক নেতাদের জন্য এ থেকে শিক্ষা নেওয়ার অনেক কিছুই রয়েছে।


 আজ ১৫ই আগস্ট প্রয়াণ দিবসে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতির প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধা। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে এ মহান মানুষটির নেতৃত্বে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি, আমরা পেয়েছি সার্বভৌমত্ব; বিশ্বের বুকে একটি নতুন দেশের আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল একাত্তরের ১৬ই ডিসেম্বরে— যে দেশটির নাম বাংলাদেশ। গভীর শ্রদ্ধা জাতির জনকের প্রতি।অন্নদাশঙ্কর রায়ের কাছ থেকে ঋণ করে বলি— যতকাল রবে পদ্মা-মেঘনা- গৌরী-যমুনা বহমান, ততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।


আরো পড়ুন!

Sidebar Banner
Sidebar Banner