একটু আগে ঢাকায় টেলিফোনে কথা বলছিলাম আমার এক বন্ধুর সঙ্গে। তিনি ঢাকার একটি হাসপাতালের ডাক্তার। কাঁদতে কাঁদতে বললেন, এরাতো আমাদের বাচ্চা বাচ্চা ছেলেদেরকে মেরে একেবারে শেষ করে ফেলবে মনে হচ্ছে। আজ সারাদিনে যত গুলিবিদ্ধ ছেলেদেরকে ট্রিটমেন্ট দিয়েছি আগে কখনো এরকম দিইনি। এরা প্রায় সকলেই চৌদ্দ পনের বছরের। আহারে কী নির্মমভাবে গুলিবিদ্ধ হয়ে কাতরাচ্ছে। শরীরের একপাশ দিয়ে গুলি ঢুকে অন্য পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেছে। কারো চোখে গুলি আটকে আছে। কারো বুক ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। কারো মাথা থেকে মগজ বের হয়ে ঝুলে পড়েছে। চারদিকে রক্ত আর রক্ত। এ দৃশ্য সহ্য করার মতো নয় বন্ধু। আমরা কাঁপতে কাঁপতে, চোখের পানি মুছতে মুছতে ট্রিটমেন্ট দিয়েছি। কিন্তু অবস্থা যা দেখলাম তাতে কেউই বাঁচবে বলে মনে হয় না। এসব মৃত্যুর কোনো হিসাব নিকাশও থাকবে না। বাইরে প্রচণ্ড গোলাগুলির শব্দ শুনে হাসপাতালের জানালা দিয়ে নীচে তাকালাম। তাকিয়ে যা দেখলাম নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।পুলিশের সঙ্গে কিছু যুবক ছাত্রদেরকে নির্বিচারে গুলি করে যাচ্ছে। এ যেন যুদ্ধক্ষেত্র। শত্রুপক্ষকে মেরে সাফ করে দেয়াই এদের টার্গেট। সাইলেন্সার লাগানোয় শব্দ বের হচ্ছে না। কিন্তু আমরা দেখছি ছেলেরা একটার পর একটা রাস্তায় লুটিয়ে পড়ছে। একদিকে পুলিশ অন্যদিকে কিছু অস্ত্রধারী যুবক ছাত্রদেরকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলেছে। আহারে বাচ্চাগুলোর হাতে জাতীয় পতাকা ধরা। আমরা কলিগরা বলাবলি করছিলাম কীভাবে একটা দেশের সরকার এতটা নিষ্ঠুর হতে পারে। বাচ্চা বাচ্চা নিরস্ত্র ছেলেদের ওপর কীভাবে পুলিশ এতটা নির্দয়ভাবে গুলি চালাতে পারে। কোনো রাবার বুলেট টুলেট নয়। একদম তাজা গুলি। এসব পুলিশের কী ছেলেমেয়ে নাই! ছোটো ভাই বোন নাই! আল্লাহ এদের মনে কোনো দয়ামায়া দেন নাই! মানুষ এতটা পাষণ্ড হয় কী করে! বলতে বলতে আমার বন্ধুটি কেঁদে ফেললেন।
ঢাকার একটি হাসপাতালের আজকের চিত্র—

আমিও বাষ্পরুদ্ধ। তাঁকে কী বলব বুঝতে পারছিলাম না। আমি তাঁর পরিবারের কথা জিজ্ঞেস করলাম। বললেন আমার ছেলে ও হাজবেণ্ড সকালে মিছিলে গেছে। ওরা বাপ ছেলে আন্দোলনে। যাওয়ার সময় আমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গেছে। আমাকে বলছিল এটা আরেক মুক্তিযুদ্ধ। এই যুদ্ধে আমরা ঘরে বসে থাকতে পারি না। আমি চোখের পানি মুছতে মুছতে বললাম ফি আমানিল্লাহ।
বন্ধুটির কথা শুনে আমার গায়ে কাঁটা দিলো। চোখের পানি আটকাতে পারছিলাম না। একজন নারীর দেশপ্রেম দেখে ভীষণ আবেগ আপ্লুত হলাম। কীভাবে স্বামী, সন্তানকে উৎসর্গ করলেন দেশের জন্য। তাঁর স্বামী ও সন্তানের কথা চিন্তা করে নিজেকে বড়ই দুর্ভাগা মনে হচ্ছিল। আহারে দেশে থাকলে আমিওতো তাঁদের মতো দেশমাতৃকার এই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে পারতাম। এ যুদ্ধতো শুধু ছাত্রদের একার নয়। এ যুদ্ধ দুঃশাসনের শিকার আপামর জনগোষ্ঠীর।
সারওয়ার-ই আলম ইলফোর্ড, লণ্ডন ৪ঠা আগস্ট ২০২৪