বাংলাদেশ ১৭ জুলাই ২০২৪

কোটা আন্দোলন কি সরকারের পাতানো খেলা

post

 আন্দোলনকারীদের অনেকেরই ইচ্ছা প্রবাসজীবন। অনেকের পছন্দ কর্পোরেট জব। অনেকের রক্তে-মগজে ব্যবসাপাতির ঝোঁক। কারো পছন্দ স্টার্ট-আপ বিজনেস, উদ্যোক্তা হওয়া, অর্গানিক ফার্মিং, রেস্তোঁরা খোলা, কন্টেন্ট ক্রিয়েশন, সাংবাদিকতা, উবার ব্যবসায় নামা। কারো তালিকায় রয়েছে ফ্রিল্যান্সিং, কারো এনজিও বা বেসরকারি চাকুরি। আরো অগণিত অসংখ্য অ-সরকারী পেশা। অনেকের মাথায় গিজগিজ করছে অনেক নিত্যনতুন চমক জাগানো আইডিয়া। নানারকম ব্যঙ্গবিদ্রূপসহ যারা লিখছে কোটাবিরোধীরা সরকারি চাকুরি পেতে এতটা মরিয়া কেন, তাদের বেশিরভাগেরই প্রোফাইল নেড়েচেড়ে নিশ্চিত হলাম কে কতোটা ধান্দাবাজ ও মতলবি দলবাজ অথবা পাঁড় মূর্খ। তারা ঠিকই জানে সরকারি চাকুরি কোটাবিরোধীদের অনেকেরই কাংখিত পেশা নয়। প্রশ্ন উঠতেই পারে সকল অ-সরকারি পেশায় আগ্রহী ছাত্ররাও কেন এই আন্দোলনে? বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের বড় অংশই তো বিদেশমূখো এবং অ-সরকারি পেশাপ্রেমি। তারাও কেন কোটাবিরোধী? উত্তর শেষে। আগে প্রসঙ্গক্রমে বলি, উপরে যা লিখেছি এবং পরে যা লিখব, নিজের সরাসরি জানাশোনা হতেই লিখেছি-লিখব। ২০২২ সালের শেষ দিকে ‘প্রিকারিয়াতাইজেশন ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামে একটি গবেষণায় নেমেছিলাম। গবেষণাটির একটি সেকশন ‘জব প্ল্যানিং অব গ্রাজুয়েটিং ইউনিভার্সিটি স্টুডেন্টস’ (স্নাতক হতে চলা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রছাত্রীদের পেশা-পরিকল্পনা)। এই সেকশনটির তথ্য সংগ্রহের প্রয়োজনে নানাজনের মুখে সামান্য যেটুকু শুনেছিলাম সেসবই চোখ খুলে দিতে পারার জন্য যথেষ্ঠ।] ২ গত এক-দেড় দশক কোটার শতভাগ বেনিফিসিয়ারি বর্তমান সরকার। এটিই সবচাইতে মোক্ষম দলীয় কর্মী পূনর্বাসন প্রকল্প। একটা অনির্বাচিত অগণতান্ত্রিক সরকার কোনোদিনই চাইবে না এই সোনার ডিমপাড়া হাসটিকে হাতছাড়া করতে। শুনেছি জেনেছি সরকারি চাকরী পেতে চলা লোকটির আসল যোগ্যতা কী কী দরকার? নেতা, পুলিশ, থানা, ইউনিয়ন ছাড়িয়ে ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতারও অনুমোদন-ছাড়পত্র দিয়ে নিশ্চিত করতে হয় চাকুরিপ্রার্থীটি ক্ষমতাসীন দলের সাথে সম্পৃক্ত অথবা কোনো না কোনোভাবে দলের স্বার্থে কাজে লাগবেই। তাদের চৌদ্দগোষ্ঠীর কোষ্ঠি-ঠিকুজি আমলনামা ঘেটেঘেটে দেখা হয় আত্মীয়স্বজনের মাঝে কেউ একজনও কোনোভাবেই কোনোদিনও সরকারবিরোধি ভাব-ভাবনার কী না! অতো অনুগত কী আর অতো সহজে মেলে? মেলে না বলে মেলাতে হয়। মেলানোর প্রক্রিয়ায় স্তরে-স্তরে ঘাটে-ঘাটে দুর্নীতি ও নগদ নারায়নের জমজমাট খেলা চলে। সেইসব দুর্নীতির চেইন রিঅ্যাকশনের সামান্য ছিঁটেফোঁটা স্যাম্পল—নিচে প্রধানমন্ত্রীর পিয়নের চারশ’ কোটি টাকা, আবেদ আলীর আল্লার রাস্তায় খরচ; উপরে বেনজির-আজিজ-মতিউর ও অসংখ্য ইনি-উনি-তিনি। সরকারি চাকুরিতে ঝাড়ুদার হতে ওপরতলার আমলা পর্যন্ত একটা দলীয় কর্মীবাহিনীর চেইন তৈরি করা হয়ে গেছে। এটা দূর্গের সুরক্ষা দিচ্ছে সরকারকে। ঘুষ-দুর্নীতি নিচ হতে উপর পর্যন্ত ক্যান্সারের মত ছড়িয়ে পড়ার একটা অন্যতম রুট এই কোটাব্যাবস্থাটি। ‘মুক্তিযুদ্ধ’ ও ‘চেতনা’কে পণ্য বানিয়ে ঝাড়ে-বংশে বেড়ে উঠছে রাষ্ট্রীয় মদতের একটি সুবিশাল ও সুসংঘটিত দূর্বৃত্তচক্র। ৩ ‘কেন অ-সরকারি পেশায় আগ্রহিরাও আন্দোলনে’ প্রশ্নটির আংশিক উত্তর দেওয়া হয়ে গেছে। চলতি সময়ে গরিব কৃষক-শ্রমিক-রিক্সাওয়ালা-গার্মেন্টস শ্রমিক রক্ত-ঘাম উজাড় করা সর্বস্ব ঢেলে দিয়ে সন্তানদের উচ্চশিক্ষার জন্য পাঠাচ্ছে। উদ্দেশ্য সন্তান প্রতিষ্ঠিত হবে। মোটামুটি মধ্যবিত্ত স্বচ্ছল ছাত্ররা চাক্ষুষ করছে তাদের হতদরিদ্র সহপাঠিটি বন্ধুটির সংগ্রাম। হতদরিদ্র জীবন-সংগ্রামীদের নেটওয়ার্ক নেই, চেনাজানা নেই, মাথার ওপর বড় ভাই নেই, চাকুরি পাবার রেফারেন্স নেই, তদবিরের ক্ষমতা নেই, মানসিকতাও নেই। অনেকেই প্রাণপাত পরিশ্রম করে। তারপরও সমুদ্রসমান অনিশ্চয়তা ও হতাশা আর দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া দেখে তাদের দাবীর পক্ষে লড়ার দায়িত্ববোধ নিয়েও সহপাঠী বন্ধুটি পথে নামে। সরকারি চাকুরি সম্মানের ও নিরাপত্তার। তাই সেটির আকাঙ্ক্ষা বেশি থাকবেই। যাদের সরকারি চাকুরি্তে আগ্রহই নেই, তাদের কি ভাই-বোন, স্বজন-বন্ধু, নিকটজনও আগ্রহি থাকতে পারে না? আগ্রহি নিকটজনদের আগ্রহ, মেধা, যোগ্যতা সবই থাকার পরও তারা বঞ্চিত হবে, এই বঞ্চনাবোধও কম বিপর্যয়কর নয়। একটি প্রজন্মের বয়স হয়েছে নির্বাচনে ভোট দেবার। কিন্তু ভোটদানের সামান্য আনন্দটুকুও তাদের কপালে জোটেনি। কোটাপন্থীরা অভিযোগ করছেন এটা কোটাবিরোধী আন্দোলন নয়, রাজনৈতিক আন্দোলন। অবশ্যই রাজনৈতিক আন্দোলন। এভ্রিথিং ইজ পলিটিক্যাল। রাজনীতি কি নাগরিকের অধিকার নয়? আরো হাজার হাজার বঞ্চনা ও নিপীড়নের ক্ষোভ এসে মগজে মিশেছে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া সাধারণ ছাত্রদের। অভিভাবক ও শিক্ষকদের তো বটেই, প্রতিটি সুনাগরিকের ও সুচিন্তার মানুষের উচিত আন্দোলনরত ছাত্রদের পাশে দাঁড়ানোর। কায়মনে প্রত্যাশা ছাত্ররা বিজয়ী হয়ে ফিরবে!

( হেলাল মহিউদ্দিন, বিশিষ্ট লেখক কলামিষ্ট ও বুদ্ধিজীবী বর্তমানে Professor, Montclair State University, New Jersey, U.S.A.)

আরো পড়ুন!

Sidebar Banner
Sidebar Banner