নিউজ ডেস্ক
টিভি নাইনটিন অনলাইন
ঢাকাঃ ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট বাংলাদেশের পটপরিবর্তনের পর থেকে এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত ঢাকা-দিল্লি সম্পর্ক তলানিতে ঠেকেছে। একাধিক ঘটনায় দুই দেশই দুই পক্ষের রাষ্ট্রদূতকে একাধিকবার তলব করেছে। সর্বশেষ গত শনিবার রাতে দিল্লিতে বাংলাদেশ মিশনে আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে এবং বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়।এর আগে গত বুধবার ঢাকায় ভারতীয় ভিসাকেন্দ্র অভিমুখে ঢাকার বিক্ষুব্ধ মানুষের পদযাত্রা এবং ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান হাদিকে হত্যার প্রতিবাদে চট্টগ্রামে ভারতীয় সহকারী হাইকমিশন কার্যালয়ের সামনে গত বৃহস্পতিবার অবস্থান নেয় ছাত্র-জনতা পরিচয় দেওয়া একদল তরুণ। রোববার চট্টগ্রামে ভারতীয় ভিসাকেন্দ্রের (আইভ্যাক) কার্যক্রম স্থগিত করা হয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সামনে নতুন রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় এলে বাংলাদেশ-ভারত দুই দেশের সম্পর্কের গতিপ্রকৃতি স্পষ্ট হবে।কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, ভারতের দিল্লির চাণক্যপুরীর কূটনৈতিক এলাকার নিরাপত্তাবেষ্টনী ভেদ করে গত শনিবার রাতে ২০ থেকে ২৫ জনের উগ্রবাদী একটি দল চার থেকে পাঁচটি গাড়িতে বাংলাদেশ হাউসের মূল ফটকের সামনে চলে আসে। এ সময় তারা বাংলাদেশবিরোধী স্লোগান দিতে থাকে। গত শনিবার রাত ৮টা ৩৫ থেকে ৮টা ৫৫ মিনিট পর্যন্ত বিক্ষোভকারীরা বাংলাদেশ হাউসের সামনে অবস্থান করে। বাংলাদেশ হাউসের গেটের সামনে এসে বিক্ষোভকারীরা কিছুক্ষণ স্লোগান দিতে থাকে। তারা বাংলা ও হিন্দি মিলিয়ে কথা বলছিল। এ সময় ‘হিন্দুদের নিরাপত্তা দিতে হবে’, ‘হাইকমিশনারকে ধর’ বলে স্লোগান দেওয়া হয়। ‘অখণ্ড হিন্দু রাষ্ট্র সেনার’ ব্যানারে বিক্ষোভকারীরা হাইকমিশনের সামনে স্লোগান দেওয়ার পর চলে যায়। শনিবার রাতের এই ঘটনার পর ব্যাখ্যা দিয়ে ভারত রোববার দুপুরে একটি প্রেস নোট জারি করে। তবে রোববার বিকালেই বাংলাদেশ ভারতের প্রেস নোট প্রত্যাখ্যান করে বিবৃতি দেয়।
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন রোববার বিকালে মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ভারতীয় প্রেস নোটে যা বলা হয়েছে এটা সম্পূর্ণভাবে আমরা প্রত্যাখ্যান করছি। সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখান করি এজন্য যে, বিষয়টি যত সহজভাবে উত্থাপন করা হয়েছে অত সহজ না। আমাদের মিশন, বাংলাদেশের মিশন কূটনৈতিক এলাকার ভেতরে, এমন না যে এটা বাহিরে কোনো জায়গায় বা কূটনৈতিক এলাকার শুরুতে; তা কিন্তু না। তারা বলছে, ২০-২৫ জনের একটি দল হতে পারে; আবার সংখ্যা বেশিও হতে পারে। ২৫ জনের একটি হিন্দু চরমপন্থি সংগঠনের লোকজন এতদূর পর্যন্ত আসতে পারবে কেন? এটা একটা সুরক্ষিত এলাকা, তার মানে তাদের আসতে দেওয়া হয়েছে। যেভাবেই হোক তারা আসতে পারার কথা না; কিন্তু তারা সেখানে হিন্দু নাগরিকের হত্যার প্রতিবাদ জানিয়ে চলে গেছে। তা না কিন্তু। তারা অনেক কিছু বলেছে, সেটা আমরা জানি।আমার কাছে প্রমাণ নেই যে, হাইকমিশনারকে হত্যার হুমকি দিয়েছে। কিন্তু আমরা এটাও শুনেছি যে, তাকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছে। আমার কথা হলো এ পর্যন্ত আসতে পারবে কেন এবং এসে হুমকি দিতে পারবে কেন। এটা আমরা গ্রহণ করি না। এখানে ব্যাপারটা এ রকম না- তারা এসেছে, দুটো স্লোগান দিয়েছে।এর ভেতরে কিন্তু একটা পরিবার বাস করে। হাইকমিশনার এবং তার পরিবার সেখানে বাস করে। তারা কিন্তু হুমকি অনুভব করেছে এবং আতঙ্কিত হয়েছে। কারণ অতিরিক্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল না, মাত্র দুজন নিরাপত্তা কর্মী ছিল; তারা চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল। কাজে এটাকে আরেকটু প্রচেষ্টা করাটা সত্যিকারে ওই দেশের দায়িত্ব।সাধারণ নিয়মে নিরাপত্তার বিষয়ে যে নিয়মকানুন আছে সেটা এখানে ভারত পালন করেনি, উল্লেখ করে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, তারা বলছে, আমাদের সব মিশনের নিরাপত্তা দেখছে, আমরা সেটা নোট করেছি। হাইকমিশনে হামলা আমাদের গণমাধ্যমে যে প্রতিবেদন এসেছে সেটাকে তারা বলছে ভুলভাবে উপস্থাপন, এটাও সত্য না।
আমাদের পত্রপত্রিকায় মোটামুটি সঠিক রিপোর্টই এসেছে। ময়মনসিংহে দীপু চন্দ্র দাসের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের প্রসঙ্গে তৌহিদ হোসেন বলেন, একজন বাংলাদেশি নাগরিক নৃশংসভাবে খুন হয়েছেন। এটার সঙ্গে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার বিষয়টি একসঙ্গে করে ফেলার কোনো মানে হয় না। যাকে হত্যা করা হয়েছে তিনি বাংলাদেশের নাগরিক এবং অবিলম্বে সে ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে বেশ কিছুকে আটক করা হয়েছে। এ ধরনের ঘটনা শুধু যে বাংলাদেশে ঘটে তা না, এ অঞ্চলের সব দেশে ঘটে এবং প্রত্যেক দেশের দায়িত্ব হচ্ছে সে ক্ষেত্রে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া। বাংলাদেশ সেই ব্যবস্থা নিচ্ছে।এ ব্যাপারে ঢাকা কোন ফরমেটে প্রতিবাদ করবে, বিশেষ করে ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় দূতকে তলব করা হবে কি না? এমন প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ফরমেট নিয়ে আমরা আলাপ না করাই ভালো। তারা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে, আমরাও রাখি; যোগাযোগ কিন্তু আছে। আমরা যেটা বলার বলি। আমরা কী করব তা আমাদের ওপর ছেড়ে দেন। আমরাতো ব্যবস্থা নিচ্ছি, সেটা দেখতে পাচ্ছেন। তারই প্রেক্ষিতে এসব কথাবার্তা হচ্ছে। আমি যে কথাটা বলছি সেটাতো বাংলাদেশ সরকারের কথা। ঢাকা ও দিল্লির টানাপড়েন বাংলাদেশ দেশটিতে মিশন ছোট করে আনার বিষয়ে ভাবছে কি না, জানতে চাইলে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা জানান, যদি তেমন পরিবেশ সৃষ্টি হয় তা হলে আমরা সেটা করব। এখন পর্যন্ত যেটা দেখছি, আমরা এখনও ভরসা রাখছি ভারত যথাযথ ব্যবস্থা নেবে।এর আগে ভারতীয় গণমাধ্যমের প্রশ্নের জবাবে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল রোববার দুপুরে বলেন, আমরা বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমের কিছু অংশে এ ঘটনা নিয়ে বিভ্রান্তিকর প্রচারণা লক্ষ করেছি। বাস্তবতা হলো, গত শনিবার নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশ হাইকমিশনের সামনে প্রায় ২০-২৫ জন যুবক জড়ো হয়ে ময়মনসিংহে দীপু চন্দ্র দাসের ভয়াবহ হত্যার প্রতিবাদে স্লোগান দেয় এবং বাংলাদেশের সব সংখ্যালঘুদের সুরক্ষার আহ্বান জানায়। এ সময় বেড়া ভাঙার বা নিরাপত্তা পরিস্থিতি তৈরি করার কোনো চেষ্টা করা হয়নি। ঘটনাস্থলে মোতায়েন পুলিশ কয়েক মিনিট পরে দলটিকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এ ঘটনার দৃশ্যমান প্রমাণ জনসমক্ষেই রয়েছে। ভিয়েনা কনভেনশন অনুসারে ভারত তার ভূখণ্ডে বিদেশি মিশন/পোস্টের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ভারত বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান পরিস্থিতির ওপর নিবিড় নজর রাখছে। আমাদের কর্মকর্তারা বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছেন এবং সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার বিষয়ে তাদের গভীর উদ্বেগ জানিয়েছেন। আমরা দীপু দাসের বর্বর হত্যাকাণ্ডের অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনার আহ্বানও জানিয়েছি।এদিকে ভারতীয় ভিসাকেন্দ্র (আইভ্যাক) রোববার এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, চট্টগ্রামে ভারতীয় সহকারী হাইকমিশনে সাম্প্রতিক নিরাপত্তা পরিস্থিতির কারণে বন্দর নগরীতে অবস্থিত ভারতীয় ভিসা আবেদন কেন্দ্রের (আইভ্যাক) কার্যক্রম রোববার থেকে স্থগিত করা হয়েছে। পরবর্তী ঘোষণা না দেওয়া পর্যন্ত চট্টগ্রামে আইভ্যাকের কার্যক্রম স্থগিত থাকবে। পরিস্থিতি পর্যালোচনার পর চট্টগ্রামে আইভ্যাকের কার্যক্রম আবার চালুর বিষয়ে ঘোষণা দেওয়া হবে।
উল্লেখ্য যে, এর আগে ‘চলমান নিরাপত্তা পরিস্থিতি’ বিবেচনায় গত বুধবার দুপুর ২টা থেকে রাজধানী ঢাকার যমুনা ফিউচার পার্কে অবস্থিত আইভ্যাকের কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়। ওইদিন জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সঙ্গে যুক্ত একাধিক সংগঠনের মোর্চা জুলাই ঐক্যের ‘মার্চ টু ইন্ডিয়ান হাইকমিশন’ কর্মসূচি ছিল। এই ঘটনার পরদিন গত বৃহস্পতিবার সকাল থেকে এই আইভ্যাকের স্বাভাবিক কার্যক্রম আবার শুরু হয়।ভারতের ওপি জিন্দাল গ্লোবাল ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. শ্রী রাধা দত্ত দৈনিক সময়ের আলোকে বলেন, দুই দেশের সম্পর্কে যা ঘটে গেছে এখন তা ভেবে লাভ নেই। এখন সবকিছু ঠান্ডা মাথায় ভাবতে হবে। বাংলাদেশে ভারতীয় মিশনে যেভাবে আক্রমণ হয়েছে সেটা খুব খারাপ বার্তা দিচ্ছে। প্রত্যাশা করি যে এমন ঘটনা আর ঘটবে না এবং পরিবর্তন ঘটবে। বাংলাদেশে কিছু এলিমেন্টস আছে ভারতের বিরুদ্ধে কাজ করে। কিন্তু আমরা এটা জানি যে, সব বাংলাদেশি এমন নয়, কিছু খারাপ এলিমেন্টস আছে যারা এমন ঘটনা ঘটায়।ড. শ্রী রাধা দত্তকে এই প্রতিবেদক গত শনিবার রাতে দিল্লিতে বাংলাদেশ মিশনে হামলার ঘটনা জানিয়ে সে বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা আমি ঠিক কতটা কী হয়েছে তা সঠিকভাবে অবগত নই। কিন্তু আপনাদের ওইখানে যদি আক্রমণ ঘটে তা হলে এখানকার মানুষ কি বসে থাকবে?সাবেক রাষ্ট্রদূত মো. মাহফুজুর রহমান দৈনিক সময়ের আলোকে বলেন, বিগত এক বছর যেহেতু বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় ছিল সেহেতু পররাষ্ট্র সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ একটা মিসিং ইয়ার পার করল। অর্থাৎ এই এক বছর বাংলাদেশ স্পষ্ট নির্দেশনাহীন একটা বছর পার করল। গুরুত্বপূর্ণ কোনো দেশই বাংলাদেশকে নিয়ে গভীর কোনো ভাবনায় জড়ায়নি, বরং যে দল বা দলগুলো সরকার গঠন করতে পারে, সে সম্ভাব্য নতুন সরকারের সঙ্গে আগে থেকে আলোচনা শুরু করেছে। এর বাইরে যেটুকু কূটনীতিতে পরিস্থিতির উদ্ভব বা বিকাশের কারণে সরকারকে সক্রিয় হতে হয়েছে তা পাকিস্তান ও ভারতের সঙ্গে কূটনীতিতে। পাকিস্তান বাংলাদেশের সঙ্গে সক্রিয় কূটনীতি নিয়ে এগিয়ে এসেছে। বাংলাদেশ বুঝে না বুঝে তাতে সাড়া দিয়েছে। ভারতের ক্ষেত্রে সম্পর্কের বৈরিতা থেকে বের হতে ভারতের কিছুটা নমনীয়তা লক্ষ করা গেলেও, এ ক্ষেত্রে ভারতকে কিছুটা পরিণত দেখা গেলেও বাংলাদেশ প্রধানত ডমেস্টিক কন্সিটিটিয়েন্সিকে সন্তুষ্ট করতে নমনীয়তার সুযোগ নেয়নি, সম্পর্ক উন্নয়নে সচেষ্ট হয়নি এবং অপরিণত আচরণ করেছে। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক নষ্ট হয় এমন বেশ কিছু ঘটনা দুই দেশেই ঘটেছে, যা দুর্ভাগ্যজনক ও উদ্বেগজনক।ভবিষ্যতে দুই দেশের সম্পর্ক নিয়ে সাবেক রাষ্ট্রদূত মো. মাহফুজুর রহমান বলেন, এমন পরিস্থিতিতে দুই দেশেরই উচিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সজাগ ও সক্রিয় করা এবং উত্তেজনা বা উসকানি বাড়তে পারে এমন ধরনের বক্তব্য না দেওয়া। কূটনৈতিক জটিলতা তৈরি হওয়ার প্রাক্কালে কূটনীতিকদেরই সবচেয়ে বেশি সক্রিয় ও দায়িত্বশীল হতে হয় এবং যোগাযোগ বাড়াতে হয়। এতে টানাপড়েনের মাত্রা স্তিমিত হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়। বাংলাদেশে নতুন সরকার গঠন না হওয়া পর্যন্ত দুই দেশের সম্পর্কের গতিপ্রকৃতি কী রকম হবে তা স্পষ্ট হবে না। তবে সম্পর্ক স্বাভাবিক করা অত সহজ হবে না।
নয়াদিল্লিতে বিক্ষোভ নিয়ে ভারতের প্রেস নোট প্রত্যাখ্যান ঢাকার








