নিউজ ডেস্ক
টিভি নাইনটিন অনলাইন
ঢাকাঃ বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রকাশিত অর্থনৈতিক তথ্য-উপাত্তের
বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে ফ্যাসিস্ট আমলে বিগত ১৫ বছর ধরেই বিতর্ক চলেছে দেশের
অর্থনীতিবিদ এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর মধ্যে। খুনি হাসিনার পতনের পর
জনসংখ্যা ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিয়ে সুক্ষ্ম প্রতারণা আরও স্পষ্ট হয়ে
উঠেছে। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে জনসংখ্যা নিয়ে সরকারি পরিসংখ্যান,
বিশেষ করে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ও মাথাপিছু আয় নিয়ে বেশ কিছু গুরুতর প্রতারণা
ও ত্রুটি-বিচ্যুতি উম্মোচিত হয়েছে। জাতিসংঘের পরিসংখ্যানেও ধরা পড়েছে
হাসিনার কারসাজি।অভিযোগের কেন্দ্রে রয়েছে দেশের অর্থনৈতিক
উন্নয়নকে অতিরঞ্জিত করে তুলে ধরতে জনসংখ্যার পরিসংখ্যান কমিয়ে দেখানো বা
অন্যান্য তথ্য-উপাত্তে কারসাজি করার বিষয়টি। বিশ্লেষকরা বলছেন, ‘উন্নয়নের
মহাসড়কের’ বয়ান প্রতিষ্ঠা করতে, বিশেষ করে মাথাপিছু আয় ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে
দেখাতে সরকারি পরিসংখ্যানে পরিকল্পিতভাবে জনসংখ্যা কমিয়ে দেখানো হয়েছে।
জাতীয় ও ঢাকা শহরের জনসংখ্যা নিয়ে সরকারি তথ্যের সঙ্গে আন্তর্জাতিক
সংস্থার তথ্যের বিশাল পার্থক্যে এই কারসাজির অন্যতম প্রধান দিক উম্মোচিত
হয়েছে। ঢাকা শহরের পরিধি ও জনসংখ্য নিয়েও করা হয়েছে মিথ্যাচার।অর্থনীতিবিদরা
বলছেন, বিগত সরকারের সময় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির যে প্রচার ছিল, তা ফাঁপা
বুলি ছাড়া আর কিছু নয়। কোনো ক্ষেত্রেই পরিসংখ্যানের যথার্থতা প্রমাণ করা
যায়নি। উচ্চ বেকারত্বই তার বড় প্রমাণ। এবছর বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সাউথ
এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) বার্ষিক অর্থনীতিবিদ
সম্মেলনে এসব কথা বলেন অর্থনীতিবিদরা।
মাথাপিছু আয়ের হিসাব যেভাবে তৈরি করা হয়
বাংলাদেশ সরকারের পরিসংখ্যান ব্যুরো বা বিবিএস এই হিসাব করে থাকে। প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা বলেছেন, এক বছরে দেশজ উৎপাদন থেকে যে আয় হয়, তার সাথে রেমিট্যান্স যোগ করে জাতীয় আয় বের করা হয়। সেই জাতীয় আয়কে মোট জনসংখ্যা দিয়ে ভাগ করে গড় মাথাপিছু বের করা হয়। যদিও এভাবে প্রকৃত চিত্র পাওয়া নিয়ে অর্থনীতিবিদের প্রশ্ন থাকছেই।
মাথাপিছু আয় বাড়ানোর কৌশল: জনসংখ্যা কম দেখানো
জিডিপি প্রবৃদ্ধি মূলত দেশের মোট উৎপাদনকে বোঝায়, যা জনসংখ্যার ওপর সরাসরি নির্ভরশীল নয়। তবে উন্নয়নের গল্পকে বিশ্ব মঞ্চে আকর্ষণীয় করে তোলার মূল হাতিয়ার হলো মাথাপিছু আয়, যা জনসংখ্যা কমালে সহজেই বেড়ে যায়।মাথাপিছু আয় গণনার সূত্র অনুসারে, ক্ষমতাচ্যুত হাসিনার আমলে জিডিপির পরিসংখ্যান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। জনসংখ্যা কম দেখিয়ে এই হর ছোট করার কৌশল ব্যবহার করা হয়েছিল। এর ফলে, অর্থনীতির মূল কাঠামো দুর্বল থাকা সত্ত্বেও, মাথাপিছু আয়ের পরিমাণ কৃত্রিমভাবে বৃদ্ধি পায় এবং আন্তর্জাতিক মহলে তা ‘উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক সফলতা’ হিসেবে প্রশংসিত হয়।অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, মাথাপিছু আয় বাড়িয়ে দেখাতে জনসংখ্যার সংখ্যা কমিয়ে দেখানো একটি কৌশল হতে পারে। যদি মোট জাতীয় আয়ের পরিমাণ অপরিবর্তিত থাকে, তবে জনসংখ্যার সংখ্যা কমিয়ে দেখানো হলে, স্বয়ংক্রিয়ভাবে মাথাপিছু আয় বেড়ে যায়। গণতান্ত্রিক সংকট ঢেকে রেখে দেশের অর্থনৈতিক উন্নতির একটি ইতিবাচক ও আকর্ষণীয় চিত্র তুলে ধরতেই এই কারসাজি করা হতে পারে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
জিডিপি প্রবৃদ্ধির অতিরঞ্জন
গণহত্যাকারী হাসিনার আমলে মাথাপিছু আয়ের পাশাপাশি দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার নিয়েও বিতর্ক রয়েছে।অনেক অর্থনীতিবিদ দীর্ঘকাল ধরে বিবিএস-এর প্রকাশিত জিডিপি পরিসংখ্যানের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান এবং অন্যান্য খাতের প্রকৃত প্রবৃদ্ধির সাথে সরকারিভাবে ঘোষিত জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার প্রায়শই অসামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল। সাম্প্রতিক অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে প্রকাশিত পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩ দশমিক ৬৯ শতাংশ। এরআগের ২০২৩-২৪ অর্থবছরের শেষ প্রান্তিকের জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩ দশমিক ৯১ শতাংশ। অথচ ক্ষমতাচ্যুত সরকারের আমলে এই একই পরিসংখ্যান অনেক বেশি দেখানো হয়েছিল। এই পার্থক্যগুলোকে আগের পরিসংখ্যানগুলো অতিরিক্ত দেখানোর প্রমাণ হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে।
জাতীয় জনসংখ্যা: কোটি মানুষের হিসাব নিয়ে বিতর্ক
২০২২ সালের জনশুমারি ও গৃহগণনা নিয়ে সৃষ্ট বিতর্ক সরকারি তথ্য-উপাত্তের প্রতি আস্থাহীনতাকে তুঙ্গে তোলে। এই জনশুমারির প্রাথমিক ফলাফলে বাংলাদেশের জনসংখ্যা মাত্র ১৬ কোটি ৫১ লাখ দেখানো হয়েছিল, যা বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ এবং জন্ম নিবন্ধন বা ভোটার সংখ্যার ভিত্তিতে অনুমিত সংখ্যার (প্রায় ১৮-২০ কোটি) চেয়ে অনেক কম।বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো প্রকাশিত জনসংখ্যা সংক্রান্ত এই তথ্যের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে দীর্ঘদিনেরই প্রশ্ন রয়েছে। এই বিতর্কের মুখে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মাধ্যমে পরিচালিত পোস্ট এনুমারেশন চেক (পিইসি) তথা গণনাত্তোর যাচাইয়ে প্রায় ৪৭ লাখ মানুষ গণনায় বাদ পড়ার তথ্য উঠে আসে। পিইসির সমন্বয়ের পর চূড়ান্ত সংখ্যা দাঁড়ায় ১৬ কোটি ৯৮ লাখ, যা প্রাথমিক সংখ্যার চেয়ে প্রায় ৪৭ লাখ বেশি। এই সমন্বয়ই প্রমাণ করে, প্রাথমিক গণনায় গণনাবহির্ভূত (আন্ডার-কাউন্টিং) জনসংখ্যা ছিল।বিশেষজ্ঞদের মত, এই বড় আকারের ‘আন্ডার-কাউন্টিং’ ইচ্ছাকৃতভাবে করা হয়েছে। কারণ, এই জনসংখ্যা কমানোর মধ্য দিয়ে অর্থনৈতিক সাফল্যের গ্রাফটিকে ঊর্ধ্বমুখী দেখানো সম্ভব হয়।জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ) জানিয়েছে, ২০২৫ সালের মধ্য-বছরের প্রাক্কলনে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা ১৭ কোটি ৫৭ লাখে দাঁড়িয়েছে| ২০২২ সালের জনশুমারি থেকে যা ৫৯ লাখ বেশি। চলতি বছরের ৭ জুলাই ইউএনএফপিএ’র ‘বিশ্ব জনসংখ্যা পরিস্থিতি ২০২৫’ সংক্রান্ত বার্ষিক প্রতিবেদনে এই তথ্য প্রকাশ করা হয়।উল্লেখ্য, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো সর্বশেষ সরকারি আদমশুমারি তথ্যের উপর ভিত্তি করে জন্ম, মৃত্যু এবং অভিবাসন হার বিবেচনা করে সাধারণত প্রক্ষেপণ বা অনুমানের মাধ্যমে প্রতি বছর মধ্য-বছরের জনসংখ্যা প্রকাশ করে।
ঢাকা সিটির জনসংখ্যা নিয়ে বিস্তর পার্থক্য
এদিকে, হাসিনার আমলে জাতীয় পরিসংখ্যানের চেয়েও বড় পার্থক্য দেখা যায় রাজধানী ঢাকার জনসংখ্যা গণনায়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জনশুমারি ও গৃহগণনা-২০২২-এর ‘ন্যাশনাল রিপোর্ট’ অনুযায়ী, দুই সিটি করপোরেশন নিয়ে গঠিত ঢাকার মোট জনসংখ্যা প্রায় ১ কোটি ৩ লাখ। কিন্তু দুই সিটির তথ্য বলছে, এ জনসংখ্যা ১ কোটি ৭৫ লাখ। বিবিএস এর সংখ্যা থেকে যা ৭৩ লাখ বেশি।অন্যদিকে, জাতিসংঘের তথ্যমতে, ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় জনসংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩.৬৬ কোটিতে, সরকারি হিসাব থেকে যা ২ কোটি ৬৪ লাখ বেশি।জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদের ‘বৈশ্বিক নগরায়ণ ধারণা-২০২৫’ প্রতিবেদনে এই অনুমান করা হয়েছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বের দ্বিতীয় প্রধান জনবহুল নগর এখন ঢাকা। শীর্ষে রয়েছে ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তা। তবে যে হারে ঢাকায় জনসংখ্যার চাপ বাড়ছে, তাতে আগামী ২০৫০ সালের মধ্যে জাকার্তাকে ছাড়িয়ে যাবে ঢাকা। তখন ঢাকা হবে বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল নগরী। জনসংখ্যা হবে প্রায় ৫ কোটি ২১ লাখ।যদিও, বিবিএস কঠোরভাবে প্রশাসনিক সীমানার (ঢাকা সিটি কর্পোরেশন) মধ্যে জনসংখ্যা গণনা করে, যার ফলে সংখ্যা কম দেখায়। অন্যদিকে, জাতিসংঘ বা অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকা বা কার্যকরী নগর অঞ্চলের বৃহত্তর সংজ্ঞা ব্যবহার করে। এই সংজ্ঞায় ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের বাইরে থাকা ঘনবসতিপূর্ণ শহরতলি, সাভার, গাজীপুর এবং নারায়ণগঞ্জের অংশবিশেষকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যা ঢাকার দৈনন্দিন জীবনের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রাক্কলন (৩ কোটি ৬৬ লাখ) ঢাকার ওপর জনসংখ্যার প্রকৃত চাপ ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ব্যাপকতা তুলে ধরলেও, সরকারিভাবে তা মাত্র ১ কোটি ২ লাখে সীমাবদ্ধ রেখে নগরায়নের সমস্যা ও চ্যালেঞ্জগুলোকে লঘু করে দেখানো হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।রাজধানীর সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও নগর পরিচালনায় জনসংখ্যার সঠিক পরিসংখ্যান জরুরি উল্লেখ করে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকার জনসংখ্যার হিসাব নিয়ে সরকারি সংস্থাগুলো অব্যাহতভাবে এমন অসামঞ্জস্য তথ্য দিয়ে গেছে। বিবিএস ও দুই সিটির জনসংখ্যার হিসাবে অসামঞ্জস্যের পাশাপাশি জনঘনত্বের হিসাবও মেলেনি।ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের জনসংখ্যা ও জনঘনত্ব নিয়ে কাজ করেছে ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি)। সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ড. আদিল মুহাম্মদ গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমরা বিভিন্ন সময় ঢাকার জনসংখ্যা নিয়ে কাজ করেছি। বিবিএস যা বলে তার চেয়ে ঢাকার প্রকৃত জনসংখ্যা আরো বেশি হওয়ার কথা। তাই আমরা বাস্তবতার কাছাকাছি থাকার জন্য বিবিএসের চেয়ে আরো ২০ শতাংশ বেশি জনসংখ্যা ধরে পরিকল্পনা করি। আমাদের হিসাবে ঢাকার জনসংখ্যা দেড় কোটির কাছাকাছি।’সমালোচকরা অভিযোগ করেন, এই ধরনের তথ্য-উপাত্তের কারসাজি (যেমন: কৃষি উৎপাদন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এবং জনসংখ্যা) রাজনৈতিক সুবিধা হাসিলের জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল, যাতে দেশের অর্থনৈতিক সফলতা আন্তর্জাতিক মহলে অতিরঞ্জিতভাবে প্রচার করা যায়।বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদদের মতে, রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য অর্থনৈতিক তথ্য-উপাত্তকে ব্যবহার করা হয়েছে, যার ফলে জিডিপির আকার ও প্রবৃদ্ধির হার বাড়ানোর পাশাপাশি মাথাপিছু আয়ও স্ফীত দেখানোর জন্য জনসংখ্যার হিসাবে এই কারসাজি করা হয়েছিল। ভবিষ্যতে এই ধরনের তথ্য বিকৃতি রোধ করতে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোকে একটি স্বাধীন এবং রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার সুপারিশ উঠেছে।অর্থনীতিবিদ ড. ফাহমিদা খাতুন এবং অন্যান্য বিশ্লেষকদের মতে, মাথাপিছু আয় হিসাব করার ক্ষেত্রে এমনকি জনসংখ্যার হিসাবও কম দেখানো হতো। যার উদ্দেশ্যই ছিল উন্নয়নের বয়ান প্রতিষ্ঠা করতে সবকিছু বাড়িয়ে দেখানো।








