বাংলাদেশ ০৬ মে ২০২৫

খালেদা জিয়া আগমন: স্লোগানে মুখর বিমানবন্দর থেকে ফিরোজা

post

নিউজ ডেস্ক
টিভি নাইনটিন অনলাইন

ঢাকাঃ
আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে- এই বাংলায়। জীবনানন্দ দাশের কবিতার শিরোনাম মিলে গেছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার বেলায়।পুরো কবিতার মতো না হলেও তিনি ফিরেছেন সুস্থ হয়ে। বহু মানুষের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করে। শত সহস্র আঘাত সহ্য করে রাজকীয় বেশে গিয়েছিলেন। ফিরেছেনও একইভাবে।মঙ্গলবার (৬ মে) বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী ফিরে আসবেন, এ খবর যেদিন প্রকাশ পায়, সেদিন থেকেই তাকে বরণ করে নেওয়ার নানা পরিকল্পনা ছিল নেতাকর্মী-সমর্থকদের মনে। কিন্তু দলের নির্দেশনা উপেক্ষা করবে, সেই সাহস হয়নি কারও। নির্দেশিত পন্থায় নেত্রীকে বরণ করে নিতে ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ভিআইপি রোডের দুই পাশে সারি ধরে দাঁড়িয়েছিলেন বিএনপির আপামর নেতাকর্মী ও সমর্থকরা। কারও হাতে বিএনপির স্লোগান সংবলিত প্ল্যাকার্ড, কেউ ব্যানার হাতে আর কাউকে উঁচিয়ে রাখতে দেখা গিয়েছে জাতীয় পতাকা ও দলীয় নিশান হাতে। এ ঢল ছিল খালেদা জিয়ার গুলশানের বাসভবন ফিরোজা পর্যন্ত।ফলে রাজধানীর একটি অংশজুড়ে সৃষ্টি হয়েছিল তীব্র যানজটের। কিন্তু কোনো ভোগান্তি যেন অনুভব করতে পারেনি কেউ। কোনো এক বড় উৎসবের খুশির মতো ঢেউ লেগেছিল রাজধানীতে। লন্ডনে চিকিৎসা শেষে চারমাস পরে গণতন্ত্রের মানসকন্যার দেশে ফেরার দিন প্রকৃতিও যেন জোট বেধেছিল। আকাশ ছিল মেঘলা, বাতাসেও ছিল অন্যরকম শান্তি।

রাজধানীতে খালেদা জিয়ার আগমন, নেতাকর্মীদের উচ্ছ্বাসে মুখর কুড়িল এলাকা
সকালের প্রথম আলো ফোটার পর সময় গড়ানোর সাথে সাথে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা ঢাকার পথে ছুটে আসেন তাদের প্রিয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার দেশে প্রত্যাবর্তনকে অভ্যর্থনা জানাতে।বেলা ১১টা পেরোতেই বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে আসা বেগম জিয়ার গাড়িবহর ধীরে ধীরে ফিরোজার উদ্দেশ্যে রওনা হয়। যখন এই বহর কুড়িল ফ্লাইওভার এলাকায় পৌঁছে, তখন পুরো এলাকা যেন এক মুহূর্তে স্লোগানে স্লোগানে মুখর হয়ে ওঠে। সাধারণত সামনে বসতে দেখা না গেলেও আজ খালেদা জিয়াকে গাড়ির সামনের সিটে বসে উপস্থিত জনতার দিকে তাকাতে দেখা যায়।নেত্রীর দেশে ফেরাকে ঘিরে নেতাকর্মীদের মাঝে এক আবেগঘন পরিবেশ বিরাজ করছিল। নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থেকে আসা ৩৭ বছর বয়সি হাফিজ আহমেদ বাংলাদেশের পতাকা কপালে বেঁধে হাতে প্রতীকী ধানের শীষ নিয়ে অভ্যর্থনায় অংশ নেন। তিনি বলেন, আমি দুই দশক ধরে দলের সঙ্গে আছি। এই সময়ে বহুবার মামলায় পড়েছি, জেলে গেছি, কিন্তু দমে যাইনি। আজকের দিনটা আমাদের জন্য বিজয়ের দিন। মুক্ত বাতাসে দাঁড়িয়ে স্লোগান দিতে পারছি—এটাই আমাদের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।ঢাকার কেরানীগঞ্জ থেকে আসা ষাটোর্ধ্ব আসলাম শেখ বলেন, গত ১৭ বছর আমি নিজের এলাকায় বিএনপির পতাকা নিয়ে, স্লোগান ধরে রাস্তায় নামতে পারিনি। আজ এখানে হাজারো মানুষের মাঝে গলা ছেড়ে স্লোগান দিচ্ছি—এ যেন বুকের ভেতর জমে থাকা সবকিছুর বহিঃপ্রকাশ।রাজধানীর বাড্ডা থেকে আগত যুবদলের কর্মী জুলহাস উদ্দিন বলেন, আমাদের নেত্রী একজন বীর যোদ্ধা। তার বিরুদ্ধে যতই মিথ্যা মামলা হোক না কেন, তিনি কখনও পালিয়ে যাননি। বরং বুক চিতিয়ে সব কিছু মোকাবিলা করে আজ বিজয়ের আলোর প্রতীক হয়ে ফিরেছেন।

যানজটও যেন আজ উৎসবের অংশ
বিএনপির পক্ষ থেকে আগে থেকেই নেতাকর্মীদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল ফুটপাতে অবস্থান নিতে, যাতে সড়কে ভিড় না হয় এবং যান চলাচল ব্যাহত না হয়। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এই নির্দেশনা নিশ্চিত করেন। সেই সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপস্থিতিও ছিল লক্ষণীয়। তবে সাময়িক কিছু যানজটের সৃষ্টি হলেও তা ভোগান্তিতে রূপ নেয়নি।গাড়িতে বসে থাকা সাধারণ মানুষও এক ঝলক নেত্রীকে দেখার অপেক্ষায় ছিলেন অধীর আগ্রহে। একটি সিএনজির গেট খুলে ৮ বছর বয়সি রাফসান দাঁড়িয়ে ছিল তার বাবা-মায়ের সঙ্গে। রাফসানের বাবা বলেন, ছেলেদের ছবি দেখিয়ে চিনিয়েছি কে আমাদের নেত্রী। আজ তারা রাস্তায় দাঁড়িয়ে তাকেই স্বচক্ষে দেখার সুযোগ পেল। আমরা জানি ইতিহাস, কিন্তু আমাদের সন্তানদের সে ইতিহাস থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। আজ সেটাও তাদের দেখানোর একটা সুযোগ।তুরাগ রুটের বাসচালক মফিজ মিয়া বলেন, এই শহরে যানজট তো নিত্যদিনের ব্যাপার। কিন্তু আজকের এই যানজট যেন আনন্দেরই একটা অংশ। নেত্রীকে কাছ থেকে দেখতে পেরেছি—এটাই বড় কিছু।গত ৭ জানুয়ারি চিকিৎসার উদ্দেশ্যে লন্ডনে গিয়েছিলেন বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। দীর্ঘ চিকিৎসা শেষে কাতারের আমিরের একটি এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে মঙ্গলবার দেশে ফিরেছেন তিনি। তার সঙ্গে দেশে ফিরেছেন পুত্রবধূ জোবাইদা রহমান এবং সৈয়দা শর্মিলা রহমান।৭৯ বছর বয়সী এই সাবেক প্রধানমন্ত্রী দীর্ঘদিন ধরে লিভার সিরোসিস, কিডনি, হার্ট, ডায়াবেটিস এবং আর্থ্রাইটিসসহ নানা শারীরিক জটিলতার শিকার। লন্ডনে গিয়ে লন্ডন ক্লিনিক নামে একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হন খালেদা জিয়া। সেখানে তিনি ১৭ দিন প্রখ্যাত বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক প্যাট্রিক কেনেডি এবং অধ্যাপক জেনিফার ক্রসের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসাধীন ছিলেন। গত ২৫ জানুয়ারি থেকে তিনি তার বড় ছেলে তারেক রহমানের বাসায় থেকে চিকিৎসা নেন।এরও আগে এক-এগারোর সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দায়ের করা হয় জিয়া অরফানেজ ও চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলা। তবে মামলাগুলোর বিচার সম্পন্ন হয় পরে, আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে। ২০১৮ সালে এই মামলায় তাকে দণ্ডিত করে কারাগারে পাঠানো হয় এবং পরবর্তীতে উচ্চ আদালতে তার সাজা বৃদ্ধি করা হয়।খালেদা জিয়াকে রাজনীতি ছাড়ার বা দেশত্যাগের প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছিল বলে জানা যায়। কিন্তু তিনি কোনো প্রস্তাবই গ্রহণ করেননি। ফলে তার কারাবরণ হয়ে ওঠে দেশে গণতন্ত্র সংকটের প্রতীকী প্রতিফলন। প্রায় তিন বছর কারাগারে কাটানোর পর, ২০২১ সালের মার্চে করোনা মহামারির প্রেক্ষাপটে সরকার নির্বাহী আদেশে তাকে সাময়িকভাবে মুক্তি দেওয়া হয়। তবে এরপর প্রায় চার বছর তিনি ছিলেন নানা শারীরিক জটিলতা এবং চিকিৎসাজনিত সীমাবদ্ধতায়। দেশে থেকেই চিকিৎসা গ্রহণ করতে হয়েছে তাকে। কারণ, তাকে বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা নেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়নি।২০২৪ সালে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ধারাবাহিকতায় রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিনের ঘোষণার মাধ্যমে তার মুক্তির পথ সুগম হয়। চলতি বছরের জানুয়ারিতে তার সাজা বাতিল হয় এবং উচ্চ আদালতের রায়ে তিনি খালাস পান। এরপর উন্নত চিকিৎসার জন্য লন্ডনে যান। তার রাজকীয় প্রত্যাবর্তন বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন প্রাণ সঞ্চার করেছে বলে মত প্রকাশ করেছেন অনেকেই।

আরো পড়ুন!

Sidebar Banner
Sidebar Banner