নিউজ ডেস্ক
টিভি নাইনটিন অনলাইন
ঢাকাঃসাম্প্রতিক বছরগুলোতে দক্ষিণ এশিয়ার কূটনৈতিক পরিস্থিতি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের মুখোমুখি হচ্ছে। নেপাল, মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কার পর নতুন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে পড়া বাংলাদেশের কূটনীতিও বৈশ্বিক গুরুত্ব পাচ্ছে।সম্প্রতি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)-এর চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে পাকিস্তান ও চীনের রাষ্ট্রদূতের বৈঠক বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে সম্ভাব্য পরিবর্তনের সংকেত দেয়।এই বৈঠকগুলো এবং বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে বাড়তি উত্তেজনা দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক চিত্র নতুন করে সাজাতে সহায়ক হতে পারে, যার ফলে ভারতকে তার কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গি পুনর্বিবেচনা করতে হতে পারে।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে উত্তেজনা
বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে বাড়তি বৈরিতা বেশ কিছু ঘটনায় উদ্ভূত হয়েছে, যা
দুই দেশের ঐতিহাসিক সম্পর্ককে চ্যালেঞ্জে ফেলেছে। আগস্টে বাংলাদেশে
সংখ্যালঘুদের নিপীড়নের অভিযোগে ভারতের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ শুরু
হয়েছিল, যা গত নভেম্বরে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলায় সাবেক ইসকন নেতা চিন্ময়
কৃষ্ণ দাসকে গ্রেপ্তারের পর আরও বেড়ে যায়। গত ২ ডিসেম্বর আগরতলার
বাংলাদেশ কনস্যুলেটে উগ্রপন্থি হিন্দুত্ববাদীরা আক্রমণ করে বসলে পরিস্থিতির
আরও অবনতি ঘটে। এ ঘটনার জন্য ভারতকে বাংলাদেশের কূটনৈতিক প্রতিক্রিয়ার
মুখে পড়তে হয়। যদিও তারা এ ধরনের ঘটনা ঠেকাতে পর্যাপ্ত নিরাপত্তার
প্রতিশ্রুতি দেয়। তবে এই ঘটনাগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে দু’দেশের মধ্যে
মিত্রতার সম্পর্ক আরও তিক্ত হয়েছে।মূলত গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের
পর বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পায়। শেখ হাসিনা পালিয়ে ভারতের
আশ্রয়ে চলে গেলে তার দল আওয়ামী লীগ কোণঠাসা হয়ে পড়ে। প্রেক্ষাপটে
আবির্ভূত হয় দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন-সংগ্রাম করে আসা বিএনপি ও তাদের সমমনা
অন্য দলগুলো। যেহেতু শেখ হাসিনা ভারতের আস্থাভাজন ছিলেন ধরা হয়, তার
বিদায়ে নতুন বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের একরকমের দূরত্ব দেখা দেয়।
পাকিস্তান ও চীনের সঙ্গে খালেদা জিয়ার কৌশলগত সম্পর্ক
অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচন করলে এতে সম্ভাব্য বিজয়ী দলের তালিকায়
বিএনপিকেই সর্বাগ্রে রাখা হচ্ছে। এই দলের প্রধান খালেদা জিয়ার সঙ্গে গত ৩
ডিসেম্বর পাকিস্তান হাইকমিশনার সাঈদ আহমেদ মারুফ এবং পরদিন ৪ ডিসেম্বর চীন
রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন বৈঠক করেন। বৈঠক দুটি বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক
সম্পর্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত বলে দেখা হচ্ছে। পাকিস্তান ও চীন,
উভয়ই ভারতবিরোধী। তারা বিএনপির ক্ষমতার প্রতি আগ্রহী হয়ে বাংলাদেশে তাদের
সম্পর্ক শক্তিশালী করতে চায়।শেখ হাসিনার শাসনামলে পাকিস্তানের সঙ্গে
বাংলাদেশের সম্পর্ক শীতল হয়ে গিয়েছিল, সেই পরিস্থিতির পর নতুন বাংলাদেশে
বিএনপিপ্রধানের সঙ্গে পাকিস্তান রাষ্ট্রদূতের বৈঠক আলাদা তাৎপর্য বহন করে।
পাকিস্তান বিএনপির সঙ্গে কৌশলগত অংশীদারিত্ব গড়ে তোলার জন্য আগ্রহী, যা
বাণিজ্য এবং প্রতিরক্ষা খাতে সহায়তা প্রদান করতে পারে। ভারতের বিবেচনায়
এটি পাকিস্তান-বাংলাদেশ সম্পর্কের পুনরুজ্জীবনের একটি সংকেত, যা তাদের চোখে
দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে ‘জটিলতা’ সৃষ্টি করতে পারে।চীনের কূটনৈতিক অংশগ্রহণ আরও বিস্তৃত কৌশলগত
লক্ষ্যবোধক। রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েনের খালেদা জিয়ার সঙ্গে আলোচনা মূলত
অর্থনৈতিক সহযোগিতা এবং অবকাঠামো উন্নয়নকে কেন্দ্র করে ছিল, যা চীনের
বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) এর সঙ্গে মিলে যায়। রাষ্ট্রদূত
ওয়েন বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের উত্তরাধিকারকে সম্মান জানিয়ে
বাংলাদেশে চীনের প্রভাব বাড়ানোর লক্ষ্য স্থির করেছেন বলে প্রতীয়মান হয়।
চীনের পক্ষ থেকে খালেদা জিয়াকে বেইজিং সফরের আমন্ত্রণ জানানোও তারই
প্রকাশ।
ভারতের কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ
এই সমস্ত ঘটনাপ্রবাহ ভারতকে একটি জটিল কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলছে।
পাকিস্তান ও চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হলে ভারত তার প্রভাব
হারানোর আশঙ্কায় পড়তে পারে, যা তারা বিস্তার করেছিল শেখ হাসিনার
শাসনামলে। বিএনপির নেতৃত্বে বাংলাদেশ যদি পররাষ্ট্রনীতিতে দিল্লি বলয় থেকে
সরে যায়, তাহলে ভারত দক্ষিণ এশিয়ায় তার অবস্থান হারাতে পারে
শোচনীয়ভাবে।বিশেষ করে, বাংলাদেশে চীনের ক্রমবর্ধমান
বিনিয়োগ ভারতের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠছে। চীন বিনিয়োগ করছে বন্দর,
সড়ক এবং বিদ্যুৎ প্রকল্পে, যা ভারত মহাসাগরের অঞ্চলে চীনের উপস্থিতি
শক্তিশালী করতে পারে। বেইজিংয়ের এ ধরনের কার্যক্রম ভারতের বাণিজ্য এবং
নিরাপত্তা স্বার্থের জন্য চ্যালেঞ্জ। একইভাবে পাকিস্তান যদি বিএনপির সঙ্গে
সম্পর্কে আরও গভীরতা আনতে সক্ষম হয় তবে সেটা ভারতের জন্য বড়সড় কূটনৈতিক
চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে।
নতুন ভূরাজনৈতিক কাঠামো এবং ভারত
বলা যায়, বাংলাদেশ ইস্যুতে দেড় দশকের মধ্যে ভারতের জন্য এমন পরিস্থিতি
নতুন। এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় ভারতকে কৌশলী ও বাস্তবধর্মী হবে।
বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য, বিনিয়োগ এবং জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক শক্তিশালী
করা ভারতের জন্য কাজটা করতে পারে। তদুপরি, বিএনপির মতো সব রাজনৈতিক দলের
সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখা ভারতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হবে, যাতে সঠিক
কূটনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা করা যায়।খালেদা জিয়ার সঙ্গে পাকিস্তান ও চীনের
রাষ্ট্রদূতের বৈঠক দক্ষিণ এশিয়ার কূটনীতিতে পরিবর্তন এবং কৌশলগত
পুনর্গঠনের একটি সুস্পষ্ট সংকেত। বাংলাদেশ যখন তার বিদেশনীতি বৈচিত্র্যময়
করার চেষ্টা করছে, ভারতকে তার স্বার্থ রক্ষা এবং বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের
প্রতি শ্রদ্ধা রেখে তার কূটনৈতিক কৌশলকে নমনীয় করতে হবে। সূত্র: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম