বরগুনা পৌরসভার অনিয়ম-দুর্ণীতি চরমে পৌঁছেছে। টেন্ডার ছাড়াই হয়েছে অধিকাংশ ঠিকাদারী কাজ। শ্বশুর শাহাদাত হোসেন বাবুল মেয়র এবং তার একমাত্র জামাতা আরিফ খানের নিয়ন্ত্রণেই পৌরসভার গুরুত্বপূর্ণ সব কাজ হয়ে থাকে। নবায়ন না করার কারণে পৌরসভার প্রায় সকল ঠিকাদারী লাইসেন্স বাতিল হয়ে গেছে। এসব নিয়ে রয়েছে নানা অভিযোগ।
মেয়র শাহাদাত হোসেন বাবুলের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান আল মামুন এন্টারপ্রাইজ এবং তার জামাতা আরিফ খানের বাবা আবুল হোসেন খানের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের নাম আরিফ এন্ড আসিফ কোং। এছাড়াও রয়েছে- মেসার্স জিলানী ট্রেডার্স, মেয়রের ব্যক্তিগত মটোরসাইকেল ড্রাইভার আবু হানিফের মেসার্স ইসলাম এন্ড কোং, মেয়রের মামাতো ভাই মাইনুল হেসেনের মেসার্স এফএইচ এন্টারপ্রাইজ, মেসার্স মাহফুজ খান লিঃ, মেসার্স টার্ণ ঢাকা, মেসার্স রূপালী এন্টারপ্রাইজ, মেয়রের ম্যানেজার লুৎফর রহমানের মেসার্স সুমাইয়া এন্টারপ্রাইজ। এই ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানগুলোতেই সকল কাজ ভাগ করে দেওযা হয় বলে ঠিকাদাররা অভিযোগ করেছেন। গোপন সূত্রে জানা গেছে, উল্লিখিত লাইসেন্সগুলোর অনুকূলে বরগুনার পূবালী ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক এবং জনতা ব্যাংকে আলাদা আলাদা ব্যাংক হিসাব রয়েছে। এসব ব্যাংক হিসাব উল্লিখিত লাইসেন্সের সত্বাধিকারী নিজের ব্যক্তিগত স্বাক্ষরে পরিচালিত হওয়ার কথা থাকলেও এই ব্যাংক হিসাবগুলো মেয়র এবং তার একান্ত ব্যক্তিদের স্বাক্ষরে পরিচালিত হচ্ছে বলে। জামাতা আরিফ খানও পৌরসভার অনেক বিষয় নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। ঠিকাদারী কাজ ভাগবাটোয়ারার ক্ষেত্রেও তার লম্বা হাত রয়েছে।অভিযোগ রয়েছে, শাহাদাত হোসেন বাবুল মেয়র হওয়ার পর থেকে গত ১০ বছর বরগুনা পৌরসভায় কোন টেন্ডার হয়েছে তার নজির খুঁজে পাওয়া যায়নি। যদি হয়ে থাকে তা আলোর মুখ দেখেনি। চাপা টেন্ডার দিয়ে শত শত কোটি টাকার কাজ ভাগবাটোয়ারা করে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। বরগুনা পৌরসভার অধীনে ৩১০টি ঠিকাদারী লাইসেন্স ছিল। টেন্ডার না হওয়ার কারণে এসব লাইসেন্সধারী ঠিকাদাররা কখনো টেন্ডারে অংশগ্রহণ করতে পারেননি। এমনকি লাইসন্সগুলো নবায়ন না দেওয়ার কারণে ৩০৪টি লাইসেন্স বাতিল হয়ে গেছে। পৌরসভা সূত্রে জানা গেছে গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে পৌরসভা থেকে মাত্র ৬টি লাইসেন্স নবায়ন দেওয়া হয়েছে। নবায়নকৃত লাইসেন্সগুলো হলো- মেসার্স ইসলাম এন্ড কোং, মেসার্স মোস্তাফিজুর রহমান, উত্তম এন্টারপ্রাইজ, মেসার্স সুমাইয়া এন্টারপ্রাইজ, মেসার্স আলমগীর, মেসার্স কামাল হোসেন। এসব নিয়ে অনেক ঠিকাদারই ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
এ ব্যাপারে মেসার্স আশরাফুল এন্টারপ্রাইজ এর সত্বাধিকারী মো. জামাল হোসেন বলেন, ‘মেয়র ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হওয়ার জন্য নির্দিষ্ট কয়েকটি লাইসেন্সের অনুকূলে ঠিকাদারী কাজ ভাগ করে নেওয়া হয়’। মেসার্স রুনা ট্রেডার্স এর সত্বাধিকারী মীর ওয়ালিউল ইসলাম হামিম বলেন, ‘লাইসেন্স দিয়ে কাজ পাওয়া যায় না। নিজেরাই সব সিস্টেম করে কাজ নিয়ে যায়। তাছাড়া অনেক কাজ আগেই করে ফেলে, পরে টেন্ডারের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়। এজন্য টেন্ডারে অংশগ্রহন করতে পারে না’। তিনি আরো বলেন, প্রায়ই দেখা যায় মেসার্স মাহফুজ খানের নামে ঠিকাদারী কাজ দেখা যায়’।
হাসান এন্টারপ্রাইজের সত্বাতিধাকারী আনোয়ার হোসেনের লাইসেন্সটিও বাতিল হয়ে গেছে। তিনি বলেন, বর্তমান মেয়র কোন টেন্ডার কল না করার কারণে ঠিকাদাররা পৌরসভা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। মেসার্স আঁখি কনস্ট্রাকশনস এর সত্বাধিকারী মোঃ বাদল মিয়া বলেন, তার লাইসেন্সটিও নবায়ন না করার কারণে বাতিল হয়ে গেছে। তাছাড়া টেন্ডারে অংশগ্রহন করলে কোন কাজ না পাওয়ায় তিনি তার লাইসেন্সটি নবায়ন করেননি।
পৌরসভার মেগা প্রকল্প সিটিইআইপি প্রকল্পের অধীনে ১৭টি প্যাকেজে প্রায় শত কোটি টাকার উন্নয়ন কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ১৭ কোটি টাকা ব্যয়ে বাস টার্মিনাল নির্মান করেছে মেসার্স মাহফুজ খান লিঃ এর লাইসেন্সে। প্রায় ৭ কোটি টাকা ব্যয়ে টাউনহল মিলনায়তন মেয়রে বেয়াই আবুল হোসেন খান তার ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান মেসার্স আরিফ এন্ড আসিফ কোং লাইসেন্সের অনুক‚লে নির্মান করেছেন। ৬কোটি টাকা ব্যয়ে ফিস মার্কেট নির্মান করা হয়েছে মেসার্স মাহফুজ খান লিঃ এর লাইসেন্সে। ১৮ (আঠারো) লক্ষ টাকা ব্যয়ে বৈশাখী মেলা নির্মান করেছে মেয়রের জামাতা আরিফ খান। প্রায় সাড়ে ৯ কোটি টাকা ব্যয়ে ময়লা রিসাইকেল প্রকল্পের নির্মাণ কাজ করছে মেসার্স টার্ণ ঢাকা লাইসেন্সের মাধ্যমে। প্রায় ১৪ (চৌদ্দ) কোটি টাকা ব্যয়ে ওভারহেড পানি টাংকি নির্মান করা হয়েছে মেসার্স জিলানী ট্রেডার্স এর লাইসেন্সে। প্রায় ৩ (তিন) কোটি টাকা শহরের আমতলা খাল, কাঠপট্টি খাল, কালিবাড়ি খাল এবং শিবের খাল খননের কাজ করেছিল ভোলার এক ঠিকাদার। ওই ঠিকাদার অভিযোগ করে বলেন, খাল খননের কাজটি মেয়র নিজে করতে না পারায় ওই ঠিকাদারকে বিভিন্ন ভাবে চাপ প্রয়োগ করা হয় এবং বিল আটকে দেওয়া হয়। এরপর ঠিকাদার বিল না পেয়ে মেয়রের অত্যাচার নির্যাতনের মুখে খাল খনন কাজ অসম্পন্ন রেখে ওই ঠিকাদার পালিয়ে চলে যায়। এসকল স্থাপনাগুলো নির্মানে অতিরিক্ত ব্যয় ধরে এস্টিমেট করা হয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। শাহাদাত হোসেন নিজেই মেয়র, নিজেই এস্টিমেটর আবার নিজেই ঠিকাদার এমন সব মন্তব্য শোনা যায় পৌর শহরে। মেয়রের সকল কাজের সহযোগী এবং পরিকল্পনায় জামাতা আরিফ খানের নাম মানুষের মুখে মুখে রয়েছে।
এ ব্যাপারে বার বার চেষ্টার পরেও পৌর মেয়র শাহাদাত হোসেন বাবুলের নিকট থেকে কোন সাক্ষাৎকার বা তথ্য পাওয়া যায়নি। বরগুনা পৌরসভার সহকারী প্রকৌশলী এইচ এম সোলায় বলেন, মেয়রের অনুমতি ছাড়া কোন ধরণের সাক্ষাৎকার বা কোন ধরণের তথ্য প্রদান করা সম্ভব নয়।সূত্র: পূর্বপশ্চিমবিডি